কাতার বিশ্বকাপের লজ্জা: ৫৭৬০ মিনিটের ফুটবলে ১৫ হাজার মৃত্যু!

(এই প্রতিবেদনটি সরাফ আহমেদ কর্তৃক ‘প্রথম আলো’ ওয়েব ম্যাগাজিনে ১৯ নভেম্বর, ২০২২ প্রকাশিত হয়। পরিপ্রশ্নের পাঠকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক খবর হিসেবে আমরা এখানে তুলে দিলাম। বিচারের ভার পাঠকদের হাতে – সম্পাদকমণ্ডলী)

এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ কাতারে অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকাটি লিখেছে, গোপন ক্যামেরা এবং টেপসহ ছদ্মবেশী সাংবাদিকেদের তথ্য থেকে ফিফার ২৪ জন নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাতারকে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসেবে ভোট দেওয়ার দুর্নীতির বিষয়টি জানা যায়। তদন্তে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত হলে ২৪ জন নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্য দুজন আজীবন এবং কুড়ি জনকে নির্দিষ্ট সময়ের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পত্রিকাটি আরও লিখছে, কাতার এমন একটি দেশ, যারা অর্থ প্রতিপত্তি দিয়ে সবকিছু ক্রয় করতে চায়। যদিও বিশ্বকাপের আয়োজনের সিদ্ধান্তে ফিফার লোভী দুর্নীতিবাজ নির্বাহী কমিটির সদস্যরাই দায়ী। তবে কাতার নানা এজেন্সির মাধ্যমে ভোট ক্রয়ের জন্য অর্থ ও অনৈতিক প্রলোভন দেখিয়েছিল।

বাংলাদেশের ৩২ বছর বয়স্ক সুজন মিয়া একজন পাইপ ফিটার হিসেবে কাজ করতে কাতারে যান। তিনি মরুভূমিতে বিশ্বকাপের একটি অবকাঠামোতে কাজ করছিলেন। তাঁর মৃত্যুর চার দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি। হঠাৎ তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। অথচ সুজন মিয়ার কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না।

বিশ্বকাপ ফুটবলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরপরই কাতার সাতটি স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর, আবাসন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহনসহ নানা উচ্চাভিলাষী নির্মাণকাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কাতারে প্রায় ২০ লাখ অতিথি শ্রমিক বসবাস করলেও বিশ্বকাপের আয়োজনকে সামনে রেখে দেশটিতে আরও বাড়তি ৪ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এই বাড়তি শ্রমিকদের বেশির ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশ থেকে আনা হয়েছিল।

বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে অবকাঠামো নির্মাণের শীর্ষ সময়ে ৪ লাখ শ্রমিকদের মধ্য শুধু স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণ করতেই ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে মানবেতর পরিবেশে কত শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন, তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ৫ হাজার ৯২৭ জন। এই হিসাবের মধ্য ফিলিপাইন ও আফ্রিকার দেশগুলোর শ্রমিকদের বাইরে রাখা হয়েছে।

তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ‘ইন দ্য প্রাইম অব দিয়ার লাইভস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত এক দশকে, হাজার হাজার তরুণ অভিবাসীশ্রমিক কাতারে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে মারা গেছেন। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাতারে ১৫ হাজার ৭৯৯ শ্রমিক মারা গেছেন। তাঁরা কাতার সরকারের অভিবাসী মৃত্যুর রেকর্ড থেকে এই সংখ্যার কথা জানিয়েছে। এসব শ্রমিক কাতারে কাজে যাওয়ার আগে বাধ্যতামূলক ফিটনেস মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এত শ্রমিকের প্রাণহানির পরও কাতার কর্তৃপক্ষ আজ অবধি তাদের মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে।

কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রাক্কালে অতিথি শ্রমিকদের মৃত্যু বা জলবায়ু সুরক্ষার পরিবর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম এসব বিষয় এখন সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকায় সামিরা এল ওয়াসিল, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের ছয় মৃত অভিবাসীশ্রমিকের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করেছেন। সামিরা এল ওয়াসিল তাঁর প্রতিবেদনের শেষে লিখেছেন, যাঁরা ফুটবল ভালোবাসেন, তাঁরা কাতারে মৃত অভিবাসীশ্রমিকদের নিয়ে চুপ থাকতে পারেন না। সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ প্রতীকীভাবে তাদের সমাধির ওপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের যে উৎসব উচ্ছ্বাস ও নান্দকিতার ঐতিহ্য, তা ১৫ হাজার শ্রমিকের মানবেতর মৃত্যুর কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top