রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কী কারণে ?

তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য

নিউজ মিডিয়া হাউস আমাদের যা বোঝাচ্ছে আমরা তাই বুঝছি । কিন্তু বাস্তবত এই যুদ্ধকে এত সরলভাবে দেখলে হবে না । নিউজ মিডিয়া থেকে আমরা জেনেছি , রাশিয়া ইউক্রেনের মাটির তলা দিয়ে পাইপলাইনের ভিতর দিয়ে খনিজ তেল আর গ্যাস পাঠিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে চাইছে । অন্যদিকে আমেরিকা পূর্বের সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে আসা ১৪টি রাষ্ট্রকে রাশিয়া বিরোধী “ন্যাটো জোটে” অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে । নিউজ মিডিয়ার চোখ দিয়ে দেখলে একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মূল চরিত্রকে ধরা যাবে না ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একচেটিয়া বৈশ্বিক পুঁজির নিরিখে একটি গভীর দ্বন্দ্ব । এই দ্বন্দ্বের মাঝে অন্য কয়েকটি কারণকে একেবারেই বাদ দেওয়া ঠিক হবে না । এই দুই দেশের যুদ্ধের মাঝে অর্থনৈতিক কারণ যেমন আছে গুরুত্বপূর্ণভাবে , তেমনি রাজনৈতিক কারণ, ভৌগলিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ , ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সমস্ত কিছুই এই প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা জরুরী ।

১) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ কমিউনিস্ট শিবিরের অন্তর্গত হয় । এটা আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চোখে ক্রমশ অসহনীয় হয়ে ওঠে । এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হয় । রাশিয়া নামে আধুনিক রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে ৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে । পূর্ব রোমান সম্রাটরা তাঁর অভিজাত সৈন্যদের নামের সাথে ভারাঙ্গিয়ান শব্দটি ব্যবহার করত । এরাই পরবর্তীকালে রাশিয়ায় এসে বসবাস করতে শুরু করে । পরবর্তীকালে এই ভারাঙ্গিয়ানরা স্লাভদের সাথে মিশে যায় এবং নভোগোরোদ ( যা পরবর্তীকালে রাশিয়া ) রাষ্ট্র  তৈরী করে । এই রাষ্ট্রের রাজধানী হয় কিয়েভ যা এখন ইউক্রেনে অবস্থিত । এই কিয়েভ-রাশিয়া মঙ্গোলদের আক্রমনে (১২৩৭ থেকে ১২৪০) আলাদা হয়ে যায় নভোগোরোদ-রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন রুশ-বিপ্লব পরবর্তীকালে পুণরায় রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে সোভিয়েত-রাশিয়ায় সংযুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে ইউক্রেন সহ ১৪ টি রাষ্ট্র রাশিয়া থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয় ।

২) সাংস্কৃতিক তথা ভৌগলিক কারণ ।

বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী এই “কিয়েভ” নগরী ছিল রুশদের প্রাচীন ভিটে । ডনবস নদীর ধার ধরে অংশে , ক্রিমিয়ায় , বেলারুশে রুশ ভাষার আধিপত্য ছিল । ইউক্রেনীয় ভাষার সাথে রুশ ভাষার অনেক মিল আছে । ইউক্রেনীয়রা রুশ ভাষা ভালো বোঝে ।  ইউক্রেন রুশীয়দের আধিপত্যের জাল ছিঁড়ে ১৯৯১ সালে স্বাধীন হয়। এর আগে এই ইউক্রেন ছিল রাশিয়ার শস্য-ভান্ডার ও খনিজভান্ডার। অন্যদিকে রাশিয়ার সীমানায় আছে ১৬ টি দেশ । তাই ভৌগলিক কারণে রাশিয়া খুবই অসুরক্ষিত। রাশিয়া ইউক্রেনের মাটির তলদেশ দিয়ে তেল , গ্যাসের পাইপলাইন নিয়ে গেছে গোটা ইউরোপে বাণিজ্যের প্রয়োজনে । আর সেজন্যে ইউক্রেন দখল ।

৩) রাজনৈতিক কারণ

আমেরিকা ও ইউরোপের ১২টি দেশ NATO জোট গঠন করে ওয়ারশ চুক্তির বিরুদ্ধে তথা স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে । ওয়ারশ চুক্তি বাতিল হয়েছে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত-রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষিতে । পূর্ব-ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলি রাশিয়ার পতনের প্রেক্ষিতে ন্যাটো জোটে সামিল হয় এক মেরু বিশ্বের নেতা আমেরিকাকে মান্যতা দেওয়ার জন্যে । সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সৈন্য মোতায়েন করে তাদের ধামাধারী পুতুল সরকার গঠন করে সেখানে। লক্ষাধিক আফগান নিরীহ নাগরিক মারা যায় সেই শাসনে। আর্থিক ক্ষতি এবং মর্যাদা হানি হয় সোভিয়েতের। এই সময় গোটা পূর্ব- ইউরোপ পুঁজিবাদী শিবিরে যোগ দেয় । কমিউনিস্ট পূর্ব-জার্মানি মিলিত হয় পশ্চিম-জার্মানির সাথে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন ঘটে পাকাপাকি ভাবে এবং সোভিয়েতের ১৪ টি অঙ্গরাজ্য স্বাধীন হয়ে যায় ।

১৯৪৯ সালে  ন্যাটো অ্যালায়েন্সের ১২টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল: বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। অন্যান্য সদস্য দেশগুলি হল: গ্রীস এবং তুরস্ক (১৯৫২), জার্মানি (১৯৫৫), স্পেন (১৯৮২), চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড (১৯৯৯), বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়া (২০০৪) , আলবেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া (২০০৯), মন্টিনিগ্রো (২০১৭) এবং উত্তর মেসিডোনিয়া (২০২০)। ক্রমাগত সামরিক শক্তি সংগঠিত হচ্ছে পূর্ব ইউরোপে। ইউক্রেন অপেক্ষায় আছে ন্যাটো ভুক্তির । সীমানা বরাবর  চারিদিকে ন্যাটো সামরিক জোটের আতঙ্কে রাশিয়া ভুগছে ।

৪) অর্থনৈতিক কারণ

২০১৪ সালে পূর্বতন সোভিয়েতের রাজ্য ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া । আমেরিকা সহ ন্যাটো জোট এতে ভয়ঙ্কর ক্ষুন্ন হয় । এরা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে। রাশিয়া ছিল অস্ত্রসমৃদ্ধ ,খনিজ ও ভোজ্য তেলসমৃদ্ধ, খাদ্যসমৃদ্ধ দেশ। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও জাপান ২০১৪ সালে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নেতারা এই অবরোধ জারি রাখে। তারা আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক’ থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । দেশ-বিদেশে বাণিজ্যি করার ক্ষেত্রে দ্রুত পেমেন্ট করার জন্যে সুইফট ( Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunications ) নামক একটি দ্রুত পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাশিয়া এর মোকাবিলায় ২০১৪ সাল থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিল । তারা আন্তর্জাতিক ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ে তৈরী করে যা সুইফটের বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতি হতে পারে। এর নাম দেওয়া হয় SPFS( System for Transfer of Financial Messages)।  এই ব্যবস্থায় সেকেন্ডের মধ্যে পেমেন্ট ফায়সালা করা যাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনে । এছাড়া ২০১৫ সালে চীন চালু করেছে ‘আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেম- CIPS’ (Cross-Border Interbank Payment System)। এ দুটো সিস্টেমই সুইফটের সমপর্যায়ের। সে কারণে সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন ডলার। বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৬% ডলারে রাখা। পাঁচ বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ৪০%। অন্যদিকে রাশিয়ার বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ১৩% রাখা চীনা মুদ্রা রেনমিনবিতে। রাশিয়া ৬৪ হাজার কোটি ডলারের ফরেন রিজার্ভ গঠন করেছে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে। চীন- ভারত- ইরান- মধ্যপ্রাচ্য হয়ে “ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” প্রকল্প বানিয়েছে চীন যা ইউরোপের মধ্যে দিয়ে যাবে আগামীদিনে । পাশাপাশি মস্কো ইতিমধ্যেই তার SPFS পেমেন্ট সিস্টেমকে শুধু চীন নয়, ভারত এবং ইউরেশিয়া ইকোনমিক ইউনিয়ন (EAEU) এর সদস্য দেশগুলির সাথেও সংযুক্ত করেছে। SPFS ইতিমধ্যেই আনুমানিক ৪০০ টি ব্যাঙ্কের সাথে লিঙ্ক করেছে ৷ ইরান ব্যাপক পরিমাণে এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। অচিরেই SPFS এবং CIPS একত্রিত হয়ে SWIFT এর বিকল্প নতুন একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং যার দ্বারা রাশিয়া তার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জনিত ক্ষতির অর্ধেকের বেশি সামাল দিতে পারবে। ভারতবর্ষও এবছর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ডিজিটাল কারেন্সি বানাতে চলেছে ।

যদি রাশিয়া-চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক  লেনদেন রিয়েল-টাইম ডিজিটাল পেমেন্টের মধ্যে দিয়ে হয়ে যায় , তাহলে আমেরিকার কতৃত্বাধীনে পেট্রো-ডলারের আধিপত্য ক্ষুন্ন হবে। এমনিতেই ডিজিটাল কারেন্সির যুগ এটা, তাই পেট্রোল-ডিজেল-কয়লা-গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেলে ডলারের আধিপত্য অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে।

আগামী দিনে ফের আবার দুটো লবির পৃথিবীতে পরিণত হবার দিন আসছে কিনা সেটাই দেখার । আমরা রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের যুদ্ধকে তাই দুই সাম্রাজ্যবাদী শিবির রাষ্ট্রের যুদ্ধ হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি । ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটের বাইরে রাখা এবং আমেরিকার অনুগত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে হঠিয়ে নিজের অনুগত কাউকে ইউক্রেনের ক্ষমতায় বসানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাবে রাশিয়া । এই যুদ্ধের কারণে প্রকৃতি পরিবেশ ও মানবজীবনের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে । ফসিল ফুয়েল আর গ্রীন লবির মধ্যে যুদ্ধ হয়তো আরো কিছুকাল চলবে । তাই এখন যুদ্ধ নয় শান্তি চাই শ্লোগান নয় , পুঁজিবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী বিশ্বমানবতার লড়াই জরুরি।

লেখক একজন নাট্যকর্মী ও পরিবেশ কর্মী এবং নানান সামাজিক কাজের যুক্ত।

ই-মেইল:  tarash01@gmail.com

Scroll to Top