ড: বিরাজলক্ষী ঘোষ
“একি অন্ধকার এ ভারতভূমি,
বুঝি পিতা তারে ছেড়ে গেছ তুমি,
প্রতি পলে পলে ডুবে রসাতলে
কে তারে উদ্ধার করিবে।
চারিদিকে চাই, নাহি হেরি গতি –
নাহি যে আশ্রয়, অসহায় অতি –
আজি এ আঁধারে বিপদ পাথারে
কাহার চরণ ধরিবে”।
কবি বলেছিলেন একশত বছর আগে। তার কলম বেয়ে ঝরে ছিল অশ্রু। দেশের জন্য দশের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় কবি তাঁর স্বদেশ গ্রন্থে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেছিলেন। কি আশ্চর্য্য আজ আমরা স্বাধীন ভারতবাসী সেই একই জায়গায় উপনীত। তবে কিসের এ স্বাধীনতা, একি কেবল বাহ্যিক নাকি অভ্যন্তরীণ? ভারতবাসীর অন্তরাত্মা মুক্ত হয়েছে কি? কবি তার স্বদেশ ভাবনায় কি বলছেন? তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা কি বলে?
কবি তার স্বদেশ ভাবনায় বলেছেন ভারতের সমস্যা রাজনৈতিক নয়। অনেকটাই সামাজিক। আর এই সমস্যাটি হলো তার জাতিগত সমস্যা। সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা যায় ভারতে বিভিন্ন জাতির সমাহার। কিন্তু তার মধ্যেই ভারত ঐক্যবদ্ধ থাকার নজির রেখেছে। নানক, কবির, শ্রী চৈতন্যের মতো বহু সন্ত এর পথ দেখিয়েছেন। এক সুতোয় বাঁধতে চেয়েছেন সকলকে।
সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে কোনো সভ্যতাই মানব সভ্যতার ইতিহাসের কথা বলে। সবার ওপর মানুষ সত্য- এই তার মর্ম বস্তু। সমস্ত জাতির নায়করাই এর অন্তর্ভুক্ত। আসলে সব জাতিগোষ্ঠীর উত্থানের ইতিহাস বৃহত্তর মানব সভ্যতার এক একটি অধ্যায়, স্থান কাল পাত্র ভেদে কেবল ভিন্ন পরিচয় যুক্ত। এটি মনে রাখা প্রয়োজন।
প্রতিটি ব্যাক্তির আত্মভালবাসা আছে অর্থাৎ আর সকলেই আমরা নিজেকে ভালোবাসি। আর এই সেল্ফ লাভ আমাদের একে অন্যের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণায় প্রবৃত্ত করে আপন ক্ষুদ্র স্বার্থ পূরণের নিরিখে। কিন্তু মানুষের এর থেকে বড় প্রবৃত্তি হলো সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সহায়তার ইচ্ছা। প্রকৃত সামাজিক মানুষ সেই দিকেই ধাবিত হন। যাঁরা এই উচ্চতর পারস্পরিকতা উপলব্ধি করতে অসমর্থ তারাই ক্রমশঃ অধঃপতিত হন। সভ্যতার শেষ হাসি তারাই হাসেন যারা এই ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণতার সীমানাকে অতিক্রম করে যান।
ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায় পূর্বে যখন ভারত তার ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ও সুবিধা গুলো পর্যাপ্ত ছিলনা, তখন তার সমস্যা গুলোর একটি ক্ষুদ্র পরিসর ছিল। পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ হলেও নৈতিকতা তাদের একই সূত্রে আবদ্ধ রেখে ছিল, যা ছিল তাদের একাত্মতার মূল উৎস। প্রতি জাতি সত্ত্বা তাদের নিজের ঐক্যকে ধরে রেখেছিল।
“যে প্রশান্ত সরলতা জ্ঞানে সমুজ্বল,
স্নেহে যাহা রসসিক্ত, সন্তোষে শীতল, ছিল তাহা ভারতের তপবনতলে;
বস্তু ভারহীন মন সর্ব জলে স্থলে
পরিব্যাপ্ত করি দিত উদার কল্যাণ;
জড়ে জীবে সর্বভূতে অবারিত ধ্যান
পশিত আত্মীয় রূপে”।
বর্তমান সমাজে এটি বহুল পরিবর্তিত। এই পৃথক জাতিসত্তাগুলি একে অপরের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশছে। যার ফলে তাদের কাছে দুটি প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথম: তারা কি জাতি ভিত্তিক ভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে ?
দ্বিতীয়: অথবা তারা একে অপরকে সম্মান জানিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বারা সেই বৃহত্তর পরিসর সৃষ্টি করবে যেগুলি তাদের সকলের সাধারণ স্বার্থকে পূরণ করে পুনর্মিলনের পথে যাবে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – তবে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন কি আদৌ সম্ভব? যাকে আমরা নেশন স্টেট বলি? কবি বললেন- হ্যাঁ সম্ভব। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার, অনেকই কবির সমালোচনা করেন তিনি জাতীয়তাবাদী নন বরং আন্তর্জাতিকতাবাদী। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝ যায় এ দুটির মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাঁর বক্তব্যে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পর্যায়ে কেবল ভৌগলিক সীমানার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিৎ। কারণ তখনকার জন্য সেই সীমানায় তাদের রাষ্ট্র শক্তিকে রূপ দেবে। এই পর্যায়ে মানুষ তার সার্বিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রাচীনত্ব, সংস্কৃতির দিকে জোর দেবে। তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে। যেখানে পারস্পরিক সম্মান বজায় থাকবে। বলাই বাহুল্য রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম শর্তই তার ভৌগলিক সীমানা।
এর দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষকে নৈতিক সঙ্গতি বিধানে এগোতে হবে। এখানে এসে সে তার জাতি স্বত্তাকে বিসর্জন দেবে না, বরং তাকে আরো ব্যাপ্তির পথে নিয়ে যাবে। অন্য সকলের সঙ্গে মিলনের দ্বারা যা হবে বিশ্বব্যাপী একটি গ্রামের ধারণা বা গ্লোবাল ভিলেজ। এখানে হবে পারস্পরিক লেনদেন। যা জাতির উন্নতির সহায়ক। আর এখানেই মানুষ সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসরণ করবে যা তাদের মধ্যে আসবে আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ দ্বারা। এই বিশ্বের মানুষ একটি বিজ্ঞানের নিয়মে আবদ্ধ- একটি তারে বাঁধা। এরা কেউ কাউকে অবজ্ঞা করতে পারে না। মানুষ ও প্রকৃতি সেই সর্বশক্তির অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। একটি ছিন্ন করলে সব কটি ছিন্ন হবে।
কবি বললেন তবে জাতি রাষ্ট্রের কি হবে? কেবল মাত্র রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থের ভিত্তিতে সেই মেলবন্ধন কখনোই সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ। এটাই আনবে সেই একাত্মতার ধারণা। কিন্তু এটি কখনই সাকার উপাসনা দ্বারা সম্ভব না। মানুষ নৈতিকভাবে চালিত হলে সেই স্বার্থহীনতায় পর্যবসিত হতে হবে যা রাষ্ট্রের মত যান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পরিচালিত করবে সঠিক পথে।
ভারতের জাত ব্যাবস্থা হলো এই সহনশীলতা ও নৈতিকতার অন্যতম উদাহরণ। ভারত হলো সেই যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সামাজিক ঐক্যের জন্য করা হয়েছে নানা পরীক্ষা এবং সেখানে আপন বৈচিত্র্য বজায় রেখে বিভিন্ন মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
মনে রাখতে হবে এই জাত ব্যাবস্থা কখনই হিমালয়ের প্রাচীরের মতো কঠিন নয় যে তাকে অতিক্রম করা যাবে না। যদি ভারতের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময় হয় আর তাকে আমরা স্থান কাল পাত্র ভেদে স্বাভাবিক বলে মানতে পারি, তাহলে জাত ব্যাবস্থাও মানব প্রকৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। এ নিয়ে বিভেদ সৃষ্টির কোনো অর্থ নেই । মানুষের সার্বিক প্রয়োজনীয়তাগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে আর বিভেদ থাকবে না মানুষে মানুষে প্রদেশে প্রদেশে।
“সমস্ত তিমির
ভেদ করে দেখিতে হইবে ঊর্ধ্ব শির
এক পূর্ণ জ্যোতির্ময়ে অনন্ত ভুবনে।
ঘোষণা করতে হইবে অসংশয় মনে—-
‘ওগো দিব্বধ্যামবাসী দেবগণ যত,
মোরা অমৃতের পুত্র তোমাদের মত।’
ঠাকুর আরো বললেন—
“মনুষ্যত্ব তুচ্ছ করি যারা সারা বেলা,
তোমারে লইয়া করে শুধু পূজা খেলা,
মুগ্ধ ভাবেভোগে, সেই বৃদ্ধ শিশুদল
সমস্ত বিশ্বের আজি খেলার পুত্তল।”
এর জন্য একটাই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তাহলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ও স্বাধীনতা। যা আসবে অন্তর থেকে। মানুষের নৈতিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন তাই ভীষন ভাবে কাম্য যা আসবে প্রকৃত শিক্ষা থেকে। কবি বলেছেন তেমন শিক্ষা শৈশবে তিনিও পাননি। সে শিক্ষায় মানবতার চেয়ে দেশ ছিল বড়। ভারতে ক্ষুধার উপর সামাজিক বিধিনিষেধগুলি চাপানো হয়। যেটা সম্ভবত অবদমনের সর্বশেষ হাতিয়ার। কবি বলেছেন আমাদের খাদ্য সৃজনশীল। যা দেহকে তৈরি করে। আমাদের সামাজিক ভাবনা গুলি আমাদের মানবিক জগৎকে নির্মাণ করে। কিন্তু আমাদের মন যখন কেবলই ক্ষমতার লোভে রাষ্ট্রযন্ত্রের পুতুলে পরিণত হয় সেখানে আমাদের শক্তি বা উদারবাদীতা কখনই স্বাধীনতা নয়। সেকারণে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনই আত্মিক স্বাধীনতা দিতে পারে না তাই সাধারন অর্থে স্বাধীন দেশ গুলিতেও মানুষ আসলে মুষ্টিমেয়র দাসত্ব করে। যা তারা উপলব্ধি করতেও সক্ষম নয়। এবং এই স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘিষ্ঠ তাদের স্বার্থ রক্ষায় ধাবিত হয়। আর সামাজিক বিধিনিষেধগুলো তাদের এক প্রকার অন্ধ ও কাপুরুষ বানিয়ে রাখে। আর সবই রাষ্ট্র যন্ত্রের খেলা। আর সেই কারণে প্রকৃত স্বাধীনতাকে উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন আত্মিক মুক্তি ও আধ্যাত্মিক চেতনা যা অনেক বৃহত্তর অর্থবহ। তবে এই চেতনা সাধারন ভাবে যাকে আমরা ধর্ম বলি তা নয়। কবি তার আত্ম পরিচয় গ্রন্থে বলেছেন “ঠিক সাধারণ যাকে ধর্ম বলে, সেটা যে আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে লাভ করতে পেরেছি, তা বলতে পারিনে। কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশঃ একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে উঠেছে, তা অনেকসময় অনুভব করতে পারি। বিশেষ কোনো একটা নির্দিষ্ট মত নয় একটা নিগূঢ় চেতনা, একটা নতুন অতিরিন্দ্রিয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমি ক্রমশ আপনার মধ্যে আপনার একটা সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারব”।
তিনি আরো বললেন- ” নিজের ভিতরকার এই সৃজন শক্তির অখণ্ড ঐক্যসূত্র যখন একবার অনুভব করা যায় তখন এই সৃজ্যমান অখন্ড বিশ্বচরাচরের সঙ্গে নিজের যোগ উপলব্ধি করি”।
অর্থাৎ তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা কোনো সাধারণ ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা নয় বরং আপন অন্তরাত্মার সেই চরম উপলব্ধি যেখানে পৌঁছালে আর মানুষে মানুষে দেশে দেশে ভেদ থাকে না। বরং বিশ্বব্যাপী মানুষ স্বাধীন ও পরিপূর্ণ ভাবে সেই ঐক্য চেতনাকে উপলব্ধি করে নিজের আত্মবিকাশে সমর্থ হয়। কবি বলেছেন- সর্বাঙ্গীন ও প্রকৃত শিক্ষা দ্বারা সেই সত্য ও সুন্দরকে উপলব্ধি করতে হবে যা আমাদের মধ্যে আত্মসংযম আনবে। এই সংযম আমাদের একে অপরের প্রতি গ্রহণযোগ্যতাকে বর্ধিত করে এক সার্বিক সমন্বয়ের পথে নিয়ে যাবে। এই একাত্মতা আনবে সেই ঐশ্বরিক উপলব্ধি যা মূর্তিপূজায় কখনোই আসবে না। তবেই ভারতবাসী শত বিভেদের মাঝে মহান মিলনের মানবতার মন্ত্রটিকে উপলব্ধি করতে পারবে ।
“যাঁরা সবল স্বাধীন
নির্ভয় সরলপ্রাণ, বন্ধনবিহীন
সদর্পে ফিরিয়েছেন বীর্যজ্যোতিষ্মান্
লঙ্ঘিয়া অরণ্য নদী পর্বত পাষাণ,
তাঁরা এক মহান বিপুল সত্যপথে
তোমারে লভিয়াছেন নিখিল জন জগতে।
কোনোখানে না মানিয়া আত্মার নিষেধ
সবলে সমস্ত বিশ্ব করেছেন ভেদ”।।
লেখক পরিচিতি:
অধ্যক্ষ- ঘোলদিগ্রুই শিক্ষণ মন্দির,
হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ।
ইমেল: