বারবার নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ জোগাড়, নাকি সহযোগিতা সহমর্মিতা বিশ্বমানবতার কথা তুলে ধরব সোচ্চার কণ্ঠে?

সন্তোষ সেন

সিএএ কী ও কেন:

সকলেই অবগত যে, ২০১৯ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করিয়ে নেয়। চার বছর ঝুলিয়ে রাখার পর ২০২৪ সালের ১১ মার্চ, নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের কয়েকদিন আগে সিএএ’ র বিধি বা রুলস তৈরি করে তা কার্যকর করা হল। এই নিয়ে বিজেপি, বিরোধী দল এবং নাগরিকদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, বাদ প্রতিবাদ চলছে। সিএএ কী ও কেন তা সংক্ষেপে বুঝে নেওয়ার পাশাপাশি আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলতে চাই পাঠকদের মননে চিন্তাভাবনার স্রোতকে উস্কে দিতে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু শিখ জৈন বৌদ্ধ পার্সি আর খ্রিস্টানরাই শুধু নাগরিকত্ব পাবেন, বলা ভালো নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। চার বছর পর আইন লাগু করার কারণ কি ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে ফেঁসে যাওয়া বিজেপির ভোট বৈতরণী পার হওয়ার মরীয়া প্রচেষ্টা? মানুষে মানুষে ধর্মীয় বিভাজন বাড়িয়ে ভোটে জেতার পথকে সুগম করার চেষ্টা? তোমাদের রাজনীতির স্বার্থে কেন দেশের গরিষ্ঠ নাগরিক বারবার করে কাগজের পিছনে ছুটবে? নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কোন অধিকার দেওয়া হয়নি রাষ্ট্র নেতাদের।

ভারতীয় সংবিধানের ৫ থেকে ১১ অনুচ্ছেদ নাগরিকত্ব সম্পর্কিত, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে – জন্মসূত্রে প্রতিটি মানুষ এই দেশের নাগরিক। বা কারোর মা ও বাবার মধ্যে একজন যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন, তাহলে তাদের সন্তান নাগরিক। এমনকি অন্যদেশ থেকে কোন মানুষ ভারতে এসে অন্তত পাঁচ বছর বসবাস করলে তিনিও নাগরিক। অথবা কেউ অবিভক্ত ভারতে
(ব্রিটিশ শাসিত ভারতের কথা বলা হয়েছে) জন্মালে বা তার মা বাবা, ঠাকুরমা ঠাকুরদার কোন একজন অবিভক্ত ভারতে জন্ম নিয়ে থাকলে তিনিও নাগরিক। অথবা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে পাকিস্তান থেকে আসা মানুষজন এবং তারপর ছয় মাস থাকার পর ভারতে নিবন্ধীকৃত যারা, নাগরিক তারাও। অনুচ্ছেদ-৮ এ বলা আছে, ভারতের বাইরে বসবাসকারী কিন্তু মা বাবা, বা ঠাকুরদা ঠাকুরমা যদি ভারতে জন্মে থাকেন তাহলেও তিনি নাগরিক। অথচ এই নিঃশর্ত নাগরিকত্বের সাংবিধানিক অধিকারের সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে বর্তমান আইনে অন্য দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত অমুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য নানাবিধ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নাগরিকত্বের আবেদনে উল্লিখিত তিনটি দেশের ৯-খানা সার্টিফিকেট, পারমিট বা পরিচয়পত্রের মধ্যে অন্তত একটি দাখিলের কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন: কোন দেশ কি তার দেশের নাগরিককে লিখে দেবেন যে, তিনি ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ওই দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন? কোন পরিচয়পত্র পেয়ে থাকলেও এতদিন তা আগলে রাখা সম্ভব? বিশেষ করে বন্যা ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প নদী-ভাঙ্গন ইত্যাদি দুর্যোগে বারবার আক্রান্ত এইসব মানুষগুলোর পক্ষে কি সম্ভব সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা? সরকার যদি সত্যি নাগরিকত্ব দিতে চায়, তাহলে ভারতে প্রাপ্ত ভোটার, রেশন, আধার কার্ড বা পাসপোর্ট এর ভিত্তিতে এইসব অসহায় মানুষগুলোকে নিঃশর্তে নাগরিকত্ব দেওয়া হবেনা কেন? সরকারের দেওয়া এইসব পরিচয়পত্রকে মূল্য না দেওয়া মানে তাদের দেওয়া নথিকেই স্বয়ং সরকার সন্দেহ প্রকাশ করছে। আবেদন করার সাথে সাথে একজন মানুষ তো নিজেকে বেনাগরিক বলে স্বীকার করে নিলেন। তাহলে “বেনাগরিক” মানুষজন এতদিন কীকরে ভোট দিলেন, তাঁদের ভোটে নির্বাচিত সরকার কীভাবে দেশের শাসনকার্য চালালেন? সবই তো তাহলে বেআইনি হয়ে যায়। প্রশ্ন অনেক। সংবিধান যে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই দেশ কি আদৌ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রমাণ প্রদান করতে পারে? সংবিধানের ১৪-অনুচ্ছেদে আইনের চোখে সমতা এবং আইনে সমভাবে সুরক্ষিত হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতভিত্তিক বৈষম্যের শিকার না হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে ১৫ অনুচ্ছেদে। এই দুই অধিকারই বাস্তবত লঙ্ঘিত হচ্ছে নতুন নাগরিকত্ব আইনে।

আবেদন করার পর যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে (কীভাবে কে ঠিক করবেন তা জানা নেই)। নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্রনোলজি অনুযায়ী এনআরসি তো অবশ্যম্ভাবী। আসামে ঠিক এটাই হয়েছে। সরকারি দপ্তরের কলমের খোঁচায় ১৯ লক্ষ মানুষকে রাতারাতি বেনগরিক ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, যায় মধ্যে ১২ লক্ষের বেশি হিন্দু ধর্মের নাগরিক। কারোর রেহাই নেই, এটা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া দরকার। ডিটেনশন ক্যাম্পই যদি ঠিকানা হয়, তাহলে সংবিধানের ২১-অনুচ্ছেদে উল্লিখিত জীবনের অধিকারও খর্ব হতে বাধ্য। অনির্দিষ্টকাল কাল ধরে একজন মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্ধগলিতে আটকে রাখা – ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্ত বিধির পরিপন্থী। অর্থাৎ এক কথায় ২০০৩ এবং তারপর ২০১৯ এর সংশোধনী আইন সম্পূর্ণভাবে বেআইনি নয় কি? সংবিধান, গণতন্ত্র, আইন, এতদিন ধরে লাগু থাকা সুযোগ-সুবিধে: এসব লঙ্ঘনের পাশাপাশি বর্তমান সংশোধনী আইন আরও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিককে হাজির করছে।

এনআরসির মধ্য দিয়ে আসামের মতো সারাদেশে লক্ষ কোটি মানুষকে বেনাগরিক করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কী চাইছে? সস্তা শ্রমিক তৈরি করাই কি এসবের আসল উদ্দেশ্য নয়? সমস্ত ধরনের পরিচয়পত্র কার্ড হারিয়ে বেনাগরিক মানুষগুলো কার্যত বাধ্য হবেন কর্পোরেটদের শর্ত মেনে সস্তা শ্রমের মজুরে পরিণত হতে। আর বেনাগরিক হয়ে যাওয়া এইসব মানুষগুলোর জমিজমা বাস্তুভিটা সহজে কেড়ে নেওয়া যাবে। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের জনজাতি এবং আদিবাসী মানুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে পাহাড় জঙ্গল নদীসহ সমস্ত খনিজ সম্পদ নির্বিচারে নির্বিবাদে লুঠ করার ছাড়পত্র পেয়ে যাবে দেশি বিদেশি বহুজাতিক হাঙ্গর কোম্পানি। বর্তমানে প্রায় ৩১ হাজার শরণার্থী অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে সিএএ আইন চালু হল ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে আসামের মতো সারাদেশে এনআরসি চালু হলে তখন আমরা কতজন বার্থ সার্টিফিকেট দিতে সমর্থ্য হব? বর্তমানে ৫০ বছরের বেশি মানুষদের জন্মের প্রমাণপত্র ছিল না। জন্মদান প্রক্রিয়া তখন হত মূলত বাড়িতেই ধাইমার তত্ত্বাবধানে। গ্রাম মফস্বলের মানুষ হাসপাতাল বিষয়টির সাথেই পরিচিত ছিলেন না। এই আলোকেই বিচার করতে হবে সিএএ ও এনআরসি আইনকে।

প্রতিবাদ প্রতিরোধ:

সিএএ কার্যকর হতেই কুপার্স পুরসভার বাসিন্দাদের মধ্যে চর্চা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের জন্য রানাঘাটের কুপার্সে গড়ে উঠেছিল ত্রানশিবির। সেই শিবিরে আসা অনেকেই পরবর্তীতে দেশের বাসিন্দা হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই পেয়েছেন নিঃশর্ত জমি, পেয়েছেন ভোটাধিকার। এই আবহে ‘সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ’ র রাজ্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বলছেন –“ সিএএ সংবিধান বিরোধী। উদ্বাস্তুদের ফের নতুন করে উদ্বাস্তু করার চক্রান্ত চলছে। আমরা এর বিরোধিতা করছি”। অনেক বাসিন্দাই বলছেন – “দেশভাগের পর পরেই আমরা এদেশে চলে আসি, ভোট দিচ্ছি। রেশন সহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা পাচ্ছি, তাহলে নতুন করে কেন আবেদন করব?” অনেকের আবার শরণার্থী শিবিরেই জন্ম, সেক্ষেত্রে তাঁরা এখানকার ভূমিপুত্র। অন্যদিকে বনগাঁ, ঠাকুরনগর সংলগ্ন মতুয়া সম্প্রদায়ের এক বড় অংশের মানুষ সিএএর বিরোধিতায় পথে নেমেছেন। ডঙ্কা কাঁসর বাজিয়ে প্রতিবাদ, অবরোধ, প্রচারপত্র বিলি চোখে পড়ছে নানান এলাকায়। আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্য – “আমরা নিঃশর্ত নাগরিকত্বের জন্য দীর্ঘদিন লড়াই করেছি। কিন্তু বর্তমান আইনে নাগরিকত্ব দেওয়ার নাম করে গুচ্ছের কাগজ চাওয়া হয়েছে। আমরা আবেদন করে নাগরিকত্ব পেতে চাই না। সরকারকে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে। তাই সিএএ বাতিলের দাবি তুলছি।”

২০১৯ সালে এনআরসি এর বিরুদ্ধে ‘নো এনআরসি সংগঠন’র ব্যানারে এই রাজ্যসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিরোধিতা, অবস্থান বিক্ষোভ চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে। কোভিডের ঢেউ এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আক্রমণে তা একপ্রকার স্তিমিত হয়ে যায় ঠিকই। তবে এবারও ‘নো এনআরসি-এনআরপি- সিএএ’ এর ব্যানারে বিভিন্ন গণসংগঠন ও অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সাথে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের এক অংশ মিছিল মিটিং লিফলেট সহযোগে তীব্র বিরোধিতার পথে নেমেছেন। নাগরিকত্বের জন্য কোন মৎস্যজীবী যাতে আবেদন না করেন, তা প্রচার করছেন ‘দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম’ এর নেতৃত্ববৃন্দ। তাঁদের বক্তব্য – “আমাদের বহু মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দাস শ্রমিক বানানোর চক্রান্ত চলছে। কারণ কর্পোরেট পুঁজির বিকাশে এই দাস শ্রমিক প্রয়োজন। এনআরসি আইনে বলা হয়েছে, জন্মগতভাবে নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৮ এর ১৯ জুলাইয়ের আগের কোন নথি থাকলে তবেই আপনি ভারতের নাগরিক হতে পারবেন।”

বিজেপি নেতৃত্বের কূটকচালি:

এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবরে, আসামে এবারে নাগরিকত্বের জন্য একজন মানুষও আবেদন করেননি। পশ্চিমবঙ্গেও আবেদনের ব্যাপারে উদ্বাস্তু মানুষদের মধ্যে বড় রকমের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁরা ভিতরে ভিতরে ফুঁসছেন, অভিযোগের ডালি নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তাই এনপিআর-এর পালে হাওয়া তুলতে বিজেপি নেতৃত্ব কোমর বেঁধে নামার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং যথারীতি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানান অপপ্রচার করে চলেছেন। হরিণঘাটার বিজেপি বিধায়ক বলেছেন – “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা আশ্বাস পেয়েছি। নির্বাচনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। নাগরিকত্বের আবেদনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে বসবাসের কিছু প্রমাণ দেওয়া বাধ্যতামূলক রয়েছে ঠিকই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম শিথিল করে প্রমাণ দেওয়া ঐচ্ছিক করে দিতে চলেছে। এছাড়া ভারতে বসবাসের প্রমাণের ক্ষেত্রে যে নয় দফা মাপকাঠি রয়েছে, সেখানে বাড়িভাড়ার রসিদ বা জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষর করা শংসাপত্র হলেও চলবে।”
একটি টিভি চ্যানেলে শান্তনু ঠাকুর কহিলেন – “সব অশিক্ষিত লোক নিয়ে বিতর্কসভা বসিয়েছেন, এরা কেউ কিছু বোঝে না। ফাইভ পাশ মানুষ কী করে আইন বুঝবে?” শাসকীয় ভাষায় সবাইকে ধমকে দিয়ে তিনি আরও বলেন –“আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, নাগরিকত্ব পেতে কারোর কোন ডকুমেন্টস লাগবে না”। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হয়ে এত বড় মিথ্যে কথাটা অন এয়ার বলে দিলেন মশায়? আর এই “অশিক্ষিত” লোকগুলোর ভোট চাইবেন না তো কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী, ডবল বি এ পাশ করা শান্তনু বাবু? পাহাড় প্রমাণ এই ঔদ্ধত্য নিয়ে মানুষের দ্বারে ভোট ভিক্ষায় যেতে লজ্জা লাগেনা আপনাদের?

আমাদের প্রশ্ন: আপনারা যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন সেগুলো কিন্তু সিএএ আইন বা বিধিতে কোথাও উল্লেখ করা নেই। তাহলে কি মানুষকে ভুল বোঝাতেই এইসব উল্টোপাল্টা বকছেন! আপনাদের আরেক প্রবীণ নেতা তথাগত বাবু তো আবার পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে নাগরিকত্ব প্রমাণের বিশেষ দাওয়াই দিয়েছেন। আসলে এটাই বিজেপির সংস্কৃতি। তারা একটি বিশেষ ধর্মের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মননে বিষ ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। এতকিছু তোড়জোড়ের পিছনে কারণ কী? স্বাধীন ভারতের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক স্ক্যাম ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই কি সিএএ লাগু করার নীল নকশা?

ইলেক্টোরাল বন্ডের কারচুপি:

নির্বাচনী বন্ডে ৭ বছরে মোট সংগ্রহ ১৬,৫১৮ কোটি টাকা। যার অর্ধেক পেয়েছে বিজেপি, তাদের প্রাপ্ত প্রায় ৮২৫০ কোটি। সবচেয়ে বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছে ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’ নামক সংস্থা (১৩৬৮ কোটি)। স্যান্টিয়াগো মার্টিন এর মালিকানাধীন এই বহুজাতিক কোম্পানির মূল ব্যবসা লটারি, যারা নানান কেলেঙ্কারিতে জড়িত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং’ সংস্থা (৯৮০ কোটি)। সীমান্তে সড়ক ও পরিকাঠামো তৈরির বিশাল বিশাল বরাত পেয়েছে এই মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা। কার্যকারণ সম্পর্কগুলো পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। শুধু ইলেক্টোরাল বন্ডের কারচুপিই নয়, প্রকাশ্যে এসেছে আরও বেশ কিছু গোপন ফান্ডের কথা।
‘ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট’ নামে আর একটি নির্বাচনী তহবিলে ২০১৩-২০২৩, এই পর্বে বিভিন্ন শিল্পসংস্থার কাছ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো ২,২৫৫ কোটি টাকা তুলেছে, তার মধ্যে ৭৫ শতাংশই গেছে বিজেপির তহবিলে। লুকিয়ে রাখা আর এক তহবিলের নাম ‘প্রুডেন্ট তহবিল’। এখান থেকেও বিজেপির কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠেছে। এমন প্রায় এক ডজন ‘অনুদান’ তহবিল এখনও সক্রিয়। এর চেয়ে বড় কোন অর্থনৈতিক দুর্নীতি স্বাধীন ভারতে হয়েছে বলে কারোর জানা নেই।

অন্যদিকের আকর্ষণীয় বিষয় –হায়দ্রাবাদের যশোদা সুপার স্পেশালিটি নামক বেসরকারি হাসপাতাল গোষ্ঠী এবং ৩৬টি ওষুধ কোম্পানি মিলে ৯০৩ কোটি টাকা ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। এদের অধিকাংশই নামি দামী কোম্পানি। কোভিডের প্রতিষেধক বিক্রি করে লাল হয়ে যাওয়া সিরাম ইনস্টিটিউট তিন ধাপে ৫০ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিল প্রুডেন্ট তহবিলে। এই টাকা প্রুডেন্ট দ্রুতগতিতে পাঠিয়ে দিয়েছে বিজেপির ভান্ডারে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোলে দেখা যাবে নির্বাচনের নামে ঘুষ নেওয়ার কেলেঙ্কারিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বিজেপির মতো স্বঘোষিত “সৎ ও নির্লোভ” একটি রাজনৈতিক দল।
প্রশ্ন ওঠায় স্বাভাবিক –স্বাস্থ্যখাতে বেলাগাম খরচ বৃদ্ধি, ওষুধের দামের ঊর্ধ্বগতির পিছনে রহস্য তাহলে প্রায় হাজার কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারি? ওষুধের দাম গত কয়েক বছরে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার তা নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকলেন কি এই কারণেই? ‘কেন্দ্রীয় মূল্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’ আইন বদল করায় বারবার ওষুধের দাম বেড়েছে। চিকিৎসক সংগঠনগুলো সহ অনেক ডাক্তারবাবুরা বলছেন –দলীয় তহবিলে কোটি কোটি টাকা দান করলে, সেটা তো আমজনতার পকেট কেটেই তুলে আনতে হবে। বন্ডে টাকা ঢেলে ওষুধ কোম্পানিগুলো সরকারি নীতি প্রভাবিত করেছে, তার ফাঁক গলে তারা চুটিয়ে ব্যবসা করেছে।”

দ্বিতীয় দফার ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শেষে বিরোধী মঞ্চের সভা থেকে (১৭.৩.২৪) রাহুল গান্ধী আওয়াজ তুলেছেন – “মোদী আসলে একটা মুখোশ, তাঁকে একটা ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে চালনা করছে বিশেষ এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যারা দেশের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। তারাই মুম্বাইয়ে বিশ্বের বৃহত্তম বস্তি ধারাভি থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করতে চাইছে (ধারাভিতে বাণিজ্যিক পরিকাঠামো নির্মাণের বরাত পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী)। তারাই আবার এনসিপি, শিবসেনা, কংগ্রেস নেতাদের ভয় দেখিয়ে দল ভাঙিয়ে বিজেপিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।”
রাহুল গান্ধী স্পষ্টতই বলেছেন – “মাত্র ২২টি কোম্পানির হাতে দেশের ৭০ কোটি মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে। এইসব বিত্তবানদের আত্মীয় স্বজনের বিয়ের জন্য রাতারাতি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হয়ে যায়।” অন্যদিকে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের বক্তব্য –“মোদি সরকারের নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থায় চারটি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। চাঁদা নিয়ে কাজের বরাত দেওয়া, চাঁদার নামে ঘুষ নেওয়া, ইডি সিবিআই এর ভয় দেখিয়ে চাঁদার নামে তোলাবাজি এবং ভুয়ো বা ভুঁইফোড় সংস্থার অধীনে চাঁদা দেওয়া হয়েছে বিজেপিকে। তাই প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের নাম নেই তালিকায়।”
ঠিক এখানেই দেশের আর্থিক বৈষম্যের চিত্রটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক। মোদি সরকারের ন’বছরে দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে টেক্কা দিয়েছে। প্যারিস স্কুল অফ ইকোনমিক্সের প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াল্ড ইনকুয়ালিটি ল্যাব’ এর গবেষণায় এই তথ্য অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণারত প্রথম সারির অর্থনীতিবিদদের মতে –“ব্রিটিশ জমানার থেকেও ভারতে এখন আর্থিক অসাম্য অনেক বেশি।” অন্যদিকে টমাস পিকেটি সহ এইসব অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য – “ভারত এখন আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে ধনকুবেরদের রাজত্ব বা বিলিয়নেয়ার রাজ্য চলছে। এর ফলে ভারতে ধীরে ধীরে ধনীদের শাসন বা ধনিকতন্ত্র (প্লুটোক্রেসি) কায়েম হতে পারে।” এই রিপোর্ট অনুসারে ২০২২-২৩ সালে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ধনীতম মাত্র এক শতাংশ ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত। আমেরিকা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশেও জাতীয় আয়ে ধনীতমদের ভাগ এত বেশি নয়। উল্টোদিকে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। এহ বাহ্য! বড়লোকদের ‘আচ্ছে দিন’ আর খুব বেশি দূরে নেই।

আমাদের ভাবনা:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই, বিশেষ করে নয়া উদার অর্থনীতির যুগে সমস্ত দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উপকরণ ছড়িয়ে দিয়ে ফাইন্যান্স পুঁজি আজ আন্তর্জাতিক। বড় বড় বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, পরিবেশ বিপর্যয় ও তার সমাধানও আজ বিশ্ব পরিসরে পরিব্যাপ্ত। তাহলে শুধুমাত্র মানুষকেই কেন জাতীয় স্তরে, বা জাত পাত বর্ণ ধর্মের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা চলবে? পুঁজির বিনিয়োগ, উৎপাদন, সঞ্চলন ও বাজারের স্বার্থে কাঁটাতারের বেড়া টপকে সে আজ বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে গেছে। তাহলে কেবল মানুষই কেন কাঁটাতারের যন্ত্রণায় বারবার বিদ্ধ হতে থাকবে একবিংশ শতকে এসেও? একজন মানুষকে কেন বারবার করে তার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে?

সামাজিক সমস্যা, যুদ্ধ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া মানুষগুলোর নাগরিকত্বের কী হবে? ইউরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে যদি এইসব দেশ নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে, তখন কী হবে? বিশ্বের নানান দেশ এর মধ্যেই মানুষের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে, মনুষ্য ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমিরাকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব বর্ণবিদ্বেষ, হিংসা ঘৃনা, অভিবাসন নীতির মতো তাস খেলে আমেরিকার ‘হেজ ফান্ড’ র বলে বলীয়ান হয়ে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে তৎপর। ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী ঋষি সুনক জানিয়েছেন –দেশের নিয়ম নীতি, আইন কানুন, সংবিধানের বিরোধিতা মানেই দেশদ্রোহীতা। সব শক্তিকেন্দ্র গুলো থেকে সহসা একই রকমের বাণী উদ্ভাসিত হচ্ছে। আসলে, এইভাবেই ভুবন জোড়া ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো মানুষকে নানান খোপে পুরে টুকরো টুকরো করতে সচেষ্ট। বিশ্বজোড়া এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে আমাদের বিশ্ব মানবতার কথা, শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতার কথা সোচ্চারে সামনে আনতে হবে। আসুন, সকলে মিলে আওয়াজ তুলি: আমরা কোন কাগজ দেখাব না। কাগজের কানাগলিতে না ছুটে মনুষ্য ধর্ম তথা সহযোগিতা সহমর্মিতা ভ্রাতৃত্ববোধ, বিশ্বমানবতার ধ্বজা সজোরে সবেগে সামনে আনি। ব্যক্তি স্বার্থের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে দেওয়া মানুষ সমস্ত বেড়াজাল ছিন্ন করে সোচ্চার কণ্ঠে বলুক: সমস্ত সামগ্রিকতায় মনুষ্য-ধর্ম, বিশ্ব নাগরিকত্বের পূজারী আমরা। মানুষ তো কখনই একক হয়ে বাঁচতে পারে না। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সমাজ মনস্ক মানুষ সবসময় অপর মানুষের কথা, সমাজের কথা ভাবে। মানুষ তার বৃহত্তর সত্তা, জীবনের অঙ্গ প্রকৃতি পরিবেশ তথা নদী পাহাড় জঙ্গল সবুজ বনানী জলাশয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব সহ বন্য প্রাণের কথা ভাবে, এগুলোই তো মনুষ্য ধর্মের মূল লক্ষণ।

মার্কস শ্রম অক্ষ থেকে বিপ্লবের মর্মবস্তু উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি পণ্যের ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্যকে মূল জায়গায় রেখে এগিয়েছেন
। অর্থাৎ exchange value বা বিনিময় মূল্য থেকে শ্রমের মুক্তির কথা তিনি বলেছেন। তাই শ্রম-বিভাজন ও শ্রম-দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসাই ছিল সমাজতন্ত্র। কিন্তুু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন করতে গিয়ে শ্রমমুক্তির আন্দোলন ক্ষুদ্র সত্তায় আটকে গেল। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কিছু সুযোগ সুবিধে পাওয়ার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী তাঁর আত্মা আন্তর্জাতিকতা থেকে বিচ্যুত হলেন। তাই মানুষকে তার ক্ষুদ্র সত্তার বাইরে বার করে ‘হায়ার সেল্ফ’ বিকশিত করার জায়গায় নিয়ে আসাটাই আজকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল কাজ। অর্থাৎ, সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক ভূমিকা, সমাজকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে তাঁর দায়দায়িত্ব, শ্রমের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে গিয়ে নিজের আরও বেশি করে পরিবর্তন বা উলম্ফন, নিজের উচ্চতর আশা
আকাঙ্ক্ষাকে জানার পাশাপাশি তাঁর বৃহত্তর সত্তা প্রকৃতিকে সম্যকরূপে জানা বোঝা, প্রকৃতির সন্তান মানুষ হিসেবে প্রকৃতিকে রক্ষা করা, পুরুষতান্ত্রিকতার নাগপাশ থেকে নারীকে মুক্ত করা: এগুলোই তো শ্রমিকশ্রেণী ও তার অগ্রণী নেতৃত্বের প্রধান কাজ। অথচ রাশিয়ার ব্যর্থতার পর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে গেল। এই ক্ষুদ্র সত্তার বাড়বাড়ন্তকে কাজে লাগিয়ে পুঁজির মাতব্বররা ‘উপযোগিতার তত্ত্ব’ সামনে নিয়ে এল। যার ফলে মানুষ আরও বেশি করে তার ক্ষুদ্র সত্তার মধ্যে আটকে গেল। আজকে আবার মানুষকে প্রতি মুহূর্তে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে চলতে হবে, সর্বক্ষণ ছুটতে হবে এই কাগজ ঐ কাগজের পিছনে। অন্যদিকে আন্দোলন করতে গেলেই নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে, এই জুজু দেখিয়ে মানুষকে সব সময় ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা যাবে।

শ্রমজীবী মানুষ, পরিবেশ রক্ষার কাজে আন্দোলনরত ছাত্র যুব সহ নাগরিক সমাজ যাতে আন্তর্জাতিকতাবাদের মতাদর্শের পথে যেতে না পারে পৃথিবীব্যাপী তার ব্যবস্থা করে রাখছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়করা। এক একটা ইসুকে ধরে: কোথাও ধর্ম, কোথাও বর্ণ, কোথাও জাতীয়তাবাদ, কোথাও আবার সবকটি দাওয়াই প্রয়োগ করে। যখন পুঁজিবাদ বুর্জুয়া ডেমোক্রেসি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তখনই তাদের এই পরিকল্পনাগুলো সামনে আনতে হচ্ছে। তার কারণ পুঁজির গ্লোবালাইজেশনের জন্য, ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থ-পুঁজিকে বাস্তবের জমিতে বিনিয়োগ করে রিয়েল করার জন্য আজ দরকার যথেচ্ছ প্রকৃতি লুণ্ঠন করা আর সস্তা দামের অনেক মজুর।

এই কারণেই প্রথমে প্রশ্ন তুলতে হবে: যে মানুষ এতদিন এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করে বসতি স্থাপন করেছেন, বারংবার তাকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে কেন। দ্বিতীয়তঃ যে মানুষ এতদিন ধরে জল জঙ্গল জমিনকে বাঁচিয়ে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের সত্যিকারের উত্তরাধিকার দখল করার লক্ষ্যে এই নাগরিকত্বের পরীক্ষাটাকে জারি রাখা হচ্ছে। এছাড়া এতদিন ধরে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বংশপরম্পরায় কায়িক শ্রম করে চলেছেন এবং মাঝে মাঝে বামপন্থীদের সাহায্যে আন্দোলনের মাধ্যমে যতটুকু যা অধিকার কায়েম করেছেন এবং সেই অধিকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানের মধ্যে আইনের আকারে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছেন। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য তাঁকে বেনাগরিক করে ক্রীতদাসে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। কারণ গরিব মানুষরা কোনদিন ভাবেননি যে, একটা কাগজের জোরে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে তাঁরা দেশে থাকতে পারবেন। তাঁরা জানেন যে, শ্রমের মাধ্যমে তাঁরাই বংশপরম্পরায় দেশ গড়ে তুলেছেন। এই দেশ তাঁদের। অতএব বাবা ঠাকুরদার মতন করে তাঁরাও এই দেশের নাগরিক হয়ে বসবাস করছেন। আজকে ৯৯ শতাংশ মানুষকে কেন এক শতাংশ মানুষের কাছে নাগরিকত্বের পরীক্ষা সবসময় দিয়ে চলতে হবে? সংবিধানে বর্ণিত অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে যেসব রাষ্ট্রনায়করা, তারা কোন্ অধিকারে নয়া নয়া আইন বিধি মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে?

আসলে রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া, সিএএ, এন আর সি, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আর এস এস, বিজেপি সহ সংঘি বাহিনী, তাদের আজন্ম লালিত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের সুপরিকল্পিত চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে দিতে চাইছে জনমানসে। আর সেই কারণে আগামী নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতায় আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই কর্নাটকের বিজেপি সাংসদ অনন্তকুমার হেগড়ে কোনরকম ঢাকঢাক গুরগুর না করে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন –
“সংবিধান পাল্টে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই ৪০০ আসন পাওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে”।

মাত্র এক শতাংশ মানুষই পৃথিবীর গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে বিনষ্ট করছে। আমাদের বেঁচে থাকার রসদ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। তাদের স্বার্থেই নানান ধরনের কালা কানুন মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুঁজির নিজস্ব সংকট কাটিয়ে তুলতে ফ্যাসিস্ট বাহিনী মানুষে মানুষে নানান ধরনের বিভেদ বিভাজন বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের মননে মগজে হিংসা ঘৃণার চাষ করা হচ্ছে। এই আওয়াজ ভীষণ জোরের সাথে তুলতে হবে। তা নাহলে মানুষের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।

1 thought on “বারবার নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ জোগাড়, নাকি সহযোগিতা সহমর্মিতা বিশ্বমানবতার কথা তুলে ধরব সোচ্চার কণ্ঠে?”

  1. Santosh Kumar Pal

    প্রাসঙ্গিক, তথ্য ও যুক্তিঋদ্ধ লেখা। লেখক ধন্যবাদার্হ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top