আন্তর্জাতিক স্তরে পরিব্যাপ্ত বিজ্ঞান প্রযুক্তি: প্রসঙ্গ জাতীয় বিজ্ঞান দিবস, ২০২৪

CV Raman

সন্তোষ সেন

১৯৮৭ সাল থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটির তাৎপর্য কি? এই বিশেষ দিনটিকে স্বনামধন্য ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি রামন কর্তৃক রামন ক্রিয়া (Raman effect) আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (১৮৮৮-১৯৭০) একজন প্রথিতযশা পদার্থ বিজ্ঞানী যিনি রামন ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

১৯৮৬ সালে ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা যোগাযোগ আয়োগ (NCSTC)’ ভারত সরকারর কাছে ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করলে সরকার এই আবেদনের অনুমোদন দেয়। ১৯৮৭ থেকে সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে এই দিবস পালন করা হয় নানান সেমিনার, আলোচনা, স্থির চিত্র ও ভিডিও প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। প্রতি বছরই বিজ্ঞান দিবসের জন্য আলাদা থিম ঘোষণা করে কেন্দ্র। দেশের আমজনতা যেন বিজ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন এবং দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের আশীর্বাদগুলো কাজে লাগান, সেই কথা মাথায় রেখেই পালিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। চলতি বছরে (২০২৪) এই বিশেষ দিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘বিকশিত ভারতের দেশীয় প্রযুক্তি’ (Indigenous Technologies for Viksit Bharat)।

দেশের সামগ্রিক উন্নতি করতে সকলেই যেন বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপে অংশ নেন, সেই বার্তা দিয়েছে কেন্দ্র। জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞানে অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য যুবকদের উৎসাহিত করা। রমন এফেক্ট আবিষ্কার উদযাপন এবং বিশ্বের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব প্রচার করা হয় এদিন। এছাড়া এদিন জনসাধারণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়। মানবজাতির অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞান আজ নিয়োজিত প্রাণ, নাকি বাজার নির্ভর অর্থ পুঁজির সেবায় সে সদা ব্যস্ত? দেশের যুব সমাজের  বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সত্যিই কী কাজ হচ্ছে, নাকি অবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান কুসংস্কারের চাষ হচ্ছে দেশ জুড়ে? বিজ্ঞান প্রযুক্তি আজ সত্যি কতটা আন্তর্জাতিক, বা তাকে কতটা জাতীয় স্তরের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে, বা জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ কীভাবে অর্থের দাসত্ব করতে গিয়ে মানুষ ও সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে –এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব এই নিবন্ধে। শুরুতেই আইনস্টাইন থেকে সি ভি রামন – এই যাত্রাপথের ইতিহাস ও তার তাৎপর্য নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

আলোর দ্বৈত্ব ধর্ম (dual nature of light) ও প্রকৃতিতে ফোটন কণার ভূমিকা:

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন দেখালেন –আলো মূলত তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ হলেও তার কণা ধর্ম বা পার্টিকেল নেচারও বিদ্যমান। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক ম্যাক্স প্লাঙ্ক এর তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে তিনি বললেন –আলোক রশ্মি অসংখ্য পার্টিকেল বা কণার সমষ্টি। তিনি এই আলোক কণিকার নাম দিলেন ফোটন (Photon) বা কোয়ান্টা, যার ভরবেগ ও শক্তি (এনার্জি) আছে, E = hf (h= Planck’s constant, f= frequency বা কম্পাঙ্ক)।

এই তত্ত্বের সাহায্যে তিনি আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার (ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট) সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হলেন। এই যুগান্তকারী তত্ত্ব আইনস্টাইনের মুকুটে নোবেল পুরস্কারের (১৯২১) পালক পরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আলোর দ্বৈত্ব ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করল। যদিও ‘ফটো ইলেক্ট্রিক এফেক্ট’ ব্যাখ্যা করার জন্য নোবেল পুরস্কারে আইনস্টাইন মোটেই খুশি হলেন না। কারণ আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে তাঁর মূল ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান: বিশেষ ও সাধারন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, যে কাজের জন্য আইনস্টাইন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যাক সেসব কথা। এদিকে ১৯২২ সালেই আর এক পদার্থ বিজ্ঞানী আর্থার হোলি কম্পটন তাঁর সুদূরপ্রসারী তত্ত্ব ও পরীক্ষা নিয়ে এলেন, যা কম্প্টন এফেক্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করল। এই আবিষ্কারের হাত ধরে ১৯২৭ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল জিতে নিলেন বিজ্ঞানী কম্প্টন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিষ্কার আলোর কণা ধর্মকে আরও শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। এবার দেখা যাক প্রকৃতি ও সমাজ বিজ্ঞানের জগতে আলোর এই ক্ষুদ্র অথচ অত্যন্ত শক্তিশালী কণা ফোটনের তাৎপর্য ঠিক কতটা।

এই ফোটনই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে রাসায়নিক জগতকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সালোকসংশ্লেষ বা photosynthesis প্রক্রিয়ার মূল উপাদান ফোটন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে auto generation process বা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। যার উপর দাঁড়িয়ে প্রানের সঞ্চার, উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে। এই বিষয়টাকে একটু বোঝা যাক। আলোক কণিকা ফোটন কোটি কোটি মাইল পথ অতিক্রম করে সবুজ পাতার ক্লোরোফিল কর্তৃক শোষিত হলে ফোটন তার শক্তির একটি অংশ ব্যয় করে ক্লোরোফিলের হৃদয় বিদীর্ণ করে ইলেকট্রনকে পরমাণু থেকে মুক্ত করে। এই বলশালী ইলেকট্রন পাতার রান্নাঘর মাইট্রোকন্ডিয়ায় আগে থেকে জমা থাকা জলের অণুকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। এখানেও সেই পার্টিকেল পার্টিকেল ইন্টারেকশন এর গল্প। প্রকৃতি বিজ্ঞানের এই অপূর্ব সুন্দর খেলা, যা প্রাণ সঞ্চারের মৌলিক শর্ত, চলে আসছে যুগ থেকে যুগান্তরের পথ বেয়ে। তারই মূলে কুঠারাঘাত করে চলেছে উন্নত মস্তিষ্কের দাবিদার একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ।

চিত্র১: সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় ফোটনের ভূমিকা।

অথচ মানুষের নিজের জন্মের প্রথম স্পন্দনকে আজ জানতে বুঝতে, এই ফোটনের চরিত্র ও ভূমিকাকে আরও গভীরে জানতে হবে। শুধুমাত্র তার তরঙ্গীয় স্পন্দন নয়, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আরও অনেক স্পন্দনকে অনুভবে আনতে পারলে তবেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড -এর সমস্ত বস্তুজগত, প্রানীজগত এক সাথে যে ছন্দবদ্ধ গতিতে স্পন্দিত ও আলোড়িত হচ্ছে, তার সুলুক সন্ধান করা সম্ভব হবে। অথচ বিজ্ঞানকে এই সমগ্রতার ব্যাপ্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নানান শাখা প্রশাখায় ভেঙে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে উল্টোপথে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে হাঁটার মরীয়া প্রচেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়েই।

তাই আজ বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে, এই বিশ্ব স্পন্দনের সাথে, সমাজ জগতকে synchronized করা। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বার্থের ক্ষুদ্র বোধ synchronization-এর এই বৃহৎ ক্ষেত্রে মিলিত হতে বাধা দিচ্ছে। তবুও বিজ্ঞানের অগ্রগতির নিজস্ব নিয়মে বিশ্বজুড়ে কিছু বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ যে অসীম সম্ভাবনার ছবি আঁকছেন, ছন্দবদ্ধতার বার্তা দিচ্ছেন, সেটাকেই সামনে আনতে হবে অর্থনীতির কুটিল আবর্ত থেকে বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে মুক্ত করে।

রামন এফেক্ট:

আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বিজ্ঞানী স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। তাঁর নামানুসারেই ফোটন কণা সমূহের অস্থিতিস্থাপক বিচ্ছুরণ (inelastic scattering) রামন এফেক্ট নামে পরিচিতি লাভ করল। ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন ও তাঁর গবেষক ছাত্ৰ ‘কে এস কৃষ্ণণ’ তরল পদার্থে ‘রামণ প্ৰভাব’ আবিষ্কার করেন। আসলে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (মনোক্রোমাটিক, যেমন লেজার বিম) আলোক রশ্মি ধূলো-ধোঁয়া মুক্ত কোনো স্বচ্ছ রাসায়নিক যৌগ বা কেলাসের (ক্রিস্টাল) ওপর আপতিত হলে আলোর একটি ছোট অংশ আপতিত দিক থেকে বিক্ষিপ্ত (স্ক্যাটার্ড) হয় এবং এই বিক্ষিপ্ত আলোর তরঙ্গদৈঘ্য বা ওয়েভলেন্থ সাধারণত বেড়ে যায়। আর আলোর বেশিরভাগ অংশটিই দিক ও তরঙ্গদৈঘ্য পরিবর্তন না করে যৌগ থেকে নির্গত হয়। যৌগের অণু কর্তৃক বিক্ষিপ্ত আলোর শক্তি কমে যাওয়া বা তরঙ্গ দৈঘ্য বেড়ে যাওয়াকেই রামন এফেক্ট বলা হয়। আগেই উল্লেখ করেছি আলো এক ধরনের কণা (পার্টিকেল) বা ফোটন, যার শক্তি আছে। এই ফোটন কোন যৌগের অণুর ওপর আপতিত হলে “পার্টিকেল পার্টিকেল ইন-ইলাস্টিক ইন্টারেকশন” এর জন্য আপতিত আলোর শক্তি কিছুটা কমে যায়, ফলে E= hc / lambda এই সূত্র মেনে তরঙ্গদৈর্ঘ্য (lambda) বেড়ে যায়, যদিও এই বৃদ্ধির পরিমাণ খুবই কম, এক ভাগের এক কোটি ভাগ মাত্র। এবং ঘটনাটি ঘটে যায় চোখের পলকে, ১০-১৪ সেকেন্ডের মধ্যে। বলে রাখা ভালো যে, স্থিতিস্থাপক বিকিরণ হলে তাকে Rayleigh scattering বলা হয়। নীচের চিত্র থেকে রামন এফেক্ট কিছুটা বোধগম্য হতে পারে।

চিত্র২: রামন এফেক্ট

ভারতের পদার্থবিজ্ঞানী স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন ১৯২৮ সালে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রথম প্রকাশ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু এর পিছনেও একটি ইতিহাস আছে। পাঁচ বছর আগেই অস্ট্রিয়ার পদার্থবিদ অ্যাডল্ফ স্মেকাল তাত্ত্বিকভাবে এই বিশেষ প্রভাব বা এফেক্টটকে বর্ণনা করেছিলেন, যদিও তিনি হাতে গরম প্রমাণ দিতে পারেন নি। অন্যদিকে সি ভি রামনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাশিয়ার দুই প্রথিতযশা পদার্থবিদ লিওনিড ম্যান্ডেলস্টাম এবং গ্রিগরি ল্যান্ডসবার্গ এই ঘটনাটি প্রথম হাতেকলমে প্রমাণ করেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে এই দুই বিজ্ঞানী তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করায় তা সেইসময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাসে রামন এফেক্টের অন্যতম অবদান: আইনস্টাইন বর্ণিত ‘আলোর কোয়ান্টাম প্রকৃতি’ আরও একবার প্রমানিত হল। এর পাশাপাশি আণবিক গঠন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। তাছাড়া ‘রামন বর্ণালী যন্ত্র বা স্পেকট্রোস্কোপি’ তৈরি হয় এই ঘটনাটির উপর ভিত্তি করেই। অণু বা ক্রিস্টালের গঠন, তার চরিত্র ও অন্য অণুর সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জানতে বুঝতে এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে এই রামন স্পেকট্রোস্কোপি, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপির সাথে যুগলবন্দী হয়ে দুর্দান্ত কাজ করে।

চিত্র ৩: রামন স্পেকট্রোস্কোপির মডেল

স্যার সি ভি রামন – কর্মজীবন:

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯১৭ সালে রামন সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এই সময়ে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (আইএসিএস) -এ গবেষণা চালিয়ে যান, যেখানে তিনি অবৈতনিক সচিব ছিলেন। বিজ্ঞানী রামন তাঁর কর্মজীবনের এই সময়টিকে সুবর্ণ যুগ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। অনেক শিক্ষার্থী, গবেষক আইএসিএস এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাছে এসে বিজ্ঞানের নানান জটিল বিষয়ে আলোচনা করতেন। ১৯২৬ সালে অধ্যাপক রামন ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানের সাময়িক পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করেন। সাময়িক পত্রিকার দ্বিতীয় খণ্ডে ‘রামন প্রভাব’ আবিষ্কারের প্রতিবেদন সমেত তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ ‘একটি নতুন বিকিরণ’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২৯ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১৬ তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হলেন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী সি ভি রামন। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারতরত্ন পুরস্কারে এবং ৫৭ সালে ‘লেনিন শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত হন। প্রথম এশীয় এবং অ-শ্বেতাঙ্গ হিসেবে বিজ্ঞানে নোবেল (১৯৩০) পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বিশ্ব দরবারে ভারতের গৌরব প্রতিষ্ঠা করলেন।  যদিও তার আগেই ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

সি ভি রামনের ভ্রাতুষ্পুত্র, ভারতের আর এক জ্যোতিষ্ক সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখরও ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখরের নাম জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ এর আবিষ্কারক হিসেবে। অনেক গাণিতিক হিসেব নিকেশ করে তিনি বললেন – কোন নক্ষত্রের ভর (mass) আমাদের সূর্যের ভরের ১.৪৪ গুণের বেশি হলে, ঐ নক্ষত্রের মৃত্যুর পর (হ্যাঁ, প্রাণীদের মতোই নক্ষত্রদেরও জন্ম, বেড়ে ওঠা ও মৃত্য চক্র আছে) তা নিউট্রন স্টার এবং ভর আরও বেশি হলে তা কৃষ্ণগহ্বর (ব্ল্যাক হোল)- এ পরিনত হবে।

কৃষ্ণগহ্বর কেন কালো?

এই বিষয়টিকে সহজ সরল করে বুঝতে হলে প্রথমেই চোখ রাখতে হবে আইনস্টাইনের  ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ এর দিকে। নিউটন বর্ণীত অভিকর্ষ বলের পরিবর্তে আইনস্টাইন নিয়ে এলেন অভিকর্ষজ ক্ষেত্র বা gravitational field এর ধারণা। জগৎবাসীর কাছে তিনি হাজির করলেন ‘স্থান-কাল বক্রতা তত্ত্ব’ (স্পেস টাইম কারভেচার)। এই তত্ত্বানুসারে –যেকোন বিষম ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বেঁকেচুরে দেয়। এই বক্র তলের মধ্য দিয়ে আলোক কণাও আর সরললেখায় চলতে পারেনা, আলোর পথও যায় বেঁকে। টেনসর গণিতের অনেক জটিল অঙ্ক কষে আইনস্টাইন এই তত্ত্ব নিয়ে এলেন ১৯১৫-১৬ সালে। অঙ্কের হিসেবনিকেশের বাস্তব প্রমাণ না পেলে তো বিজ্ঞানীদের চলে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটেনের পদার্থ বিজ্ঞানী এডিংটন ও তাঁর সহযোগীরা ১৯১৯ সালে এক পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় আলোর গতিপথকে ধরলেন অতি উন্নত মানের বর্ণালী বীক্ষণ যন্ত্রের গোলক ধাঁধায়। মাস খানেক পর আবার একইভাবে আলো কে খাঁচাবন্দী করে ছবিতে ফুটিয়ে তুললেন। ছবি মিলিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাঁরা লক্ষ্য করলেন যে, হায়েডা নক্ষত্রপুঞ্জের আলো সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তা অবলীলায় বেঁকে যাচ্ছে। আইনস্টাইনের তত্ত্বের হাতে-গরম প্রমাণ পাওয়া গেল। এক ঐতিহাসিক তত্ত্ব হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্থান-কালের বক্রতা তত্ত্ব স্থান করে নিল। এর সাথে ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ কে মিলিয়ে দিলেই কৃষ্ণগহ্বরের অন্দরের হদিস পাওয়া যাবে। কোন নক্ষত্রের ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি হলে, হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে সেই নক্ষত্রের অন্তরস্থল অতি ক্ষুদ্র (যায় আয়তন ভূগোলকের পুরো আয়তনকেও ছাপিয়ে যেতে পারে) এক কালো বস্তুতে পরিণত হয়, যায় ঘনত্ব সীমা পরিসীমা ছাড়িয়ে যায়। মহাকাশের দিগ্বিদিক ফুঁড়ে আলো এই কালো গর্তের পানে ছুটে চললে অতল গহ্বরে ঢুকে মাথা খুঁড়তে থাকে। ঐ অত্যন্ত ভারী কৃষ্ণগহ্বরের অন্তরস্থল থেকে আলো আর কোনভাবেই বাইরে বেরোতে পারেনা। প্রচণ্ড পরিমাণে বেঁকেচুরে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া স্থানের বক্রতল আলোকেও গিলে খায়। আইনস্টাইনের স্থানকাল বক্রতা তত্ত্ব থেকেই নক্ষত্রের চারদিকে গ্রহগুলোর ঘুরপাক খাওয়া তথা অভিকর্ষ ক্ষেত্রকে নির্ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আর এই তত্ত্বের সাথে ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ এর যুগলবন্দী ঘটিয়ে ব্যাখ্যা করা গেল কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব ও তার কৃষ্ণবর্ণের রহস্যকে। অধুনা অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির দূরবীন তথা ‘জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ’ ব্ল্যাকহোলের ছবিও তুলে ফেলছে পটাপট।

এইভাবেই অনেক দেশের অনেক বিজ্ঞানীর তত্ত্ব গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনেক দেশ মিলিয়ে গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তির যৌথ প্রয়াসে বিজ্ঞান এগিয়ে চলে পৃথিবী থেকে গ্রহান্তরে, গ্রহ উপগ্রহ ছাড়িয়ে নক্ষত্র মন্ডলীর সুদূর পানে। আবার তা ছাড়িয়ে ব্ল্যাকহোল থেকে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আবার প্রসারিত হতে হতে ধেয়ে চলেছে কোন্ সে অমোঘ পানে, তার গবেষণা তত্ত্বায়ন চলছে দুনিয়া জুড়েই। সেইদিকে চোখ রাখা যাক এবার তাহলে।

Global Science for Global Wellbeing:

এটা ঠিক যে, বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে, বিশেষ করে ১৯৮০ এর পর থেকে নয়া উদার অর্থনীতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও প্রকরণকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া এবং অন্যদিকে জ্ঞান (নলেজ) ও তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ এবং আন্তর্জালের মধ্য দিয়ে তা বিশ্ব দরবারে উন্মুক্ত হওয়ার ফলে বিজ্ঞানের অজানা রহস্যের সমাধানে, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান তথা মহাকাশ চর্চার ক্ষেত্রে গবেষণা, নতুন নতুন আবিষ্কার, নব নব কৃৎকৌশলের উদ্ভাবন সবই জাতীয় স্তর থেকে বেরিয়ে বিশ্বচরাচরে পরিব্যপ্ত হয়ে আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একবিংশ শতকের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও আবিষ্কারকে আনা যায়।

এক: আইনস্টাইন বর্ণিত অভিকর্ষীয় তরঙ্গ (gravitational wave) শনাক্তকরণের দুইটি অত্যাধুনিক যন্ত্র নির্মাণ এবং তার শনাক্তকরণের কাজটি সম্পন্ন হল ২০১৭ সালে। যা ছিল সম্পূর্ণ রূপে একটি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টা। এই বৈজ্ঞানিক কর্মযজ্ঞে কুড়িটির বেশি দেশের ১০০টি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের কম করে এক হাজার বিজ্ঞানী-গবেষক হাতে হাত মিলিয়ে যৌথভাবে কাজ করে গেছেন ২০০০ সাল থেকে।

দুই: সম্প্রতি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলতে সক্ষম হওয়া। ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিকাল থেকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা এক দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের যে ছবি বিশ্ববাসীর দুয়ারে আছড়ে পড়ল ২০২২ সালের ১২ ই মে, তা  আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের এক সার্থক প্রয়াস। এই দুরূহ কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল বিশ্ব চরাচরে পরিব্যপ্ত একটি আন্তর্জাতিক রিসার্চ টিম যা ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ কোলাবরেশন’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্পে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার ৮০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তিনশ’ র  বেশি গবেষক-বিজ্ঞানী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, মস্তিষ্কগুলোকে নেট দুনিয়ার গহীন জালের পাকে বেঁধে পাঁচ বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসানো ৮ খানা রেডিও-টেলিস্কোপের সমবায় ছিল এই ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ’। আজকের বাস্তবতায় প্রতিটি বড় মাপের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড আদতে এক সহযোগিতা- যূথবদ্ধতা-বিশ্বমানবতা- আন্তর্জাতিকতার মূর্ত প্রতীক।

চিত্র ৪: Illustration showing the anatomy of a supermassive black hole (ESO).

প্রসারমান ব্রহ্মাণ্ড: যাচ্ছে কোথায়?

জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে সর্বোচ্চ আলোচিত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয়টি হল –বাড়তে বাড়তে বৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিকর্ষের টানে ব্রহ্মাণ্ড কি একসময় মহাসংকোচনের পরে আবারো চুপসে যাবে কালের গর্ভে, নাকি প্রসারণ চলতেই থাকবে সময়ের সাথে সাথে? মানব শরীর বার্ধক্যের সীমায় পৌঁছে যেমন আবার কুঁকড়ে যায়, মহাবিশ্বও সেরকমভাবেই চুপসে যাবে ফোলানো বেলুনের মত –এই ছিল স্টিফেন হকিংয়ের যুক্তি। নিশ্চিত করে সংকোচনের কথা না বললেও তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’-এ কিন্তু এরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন স্টিফেন হকিং। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক এর উল্টো। মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ১৩৮০ কোটি বছর আগে শিশু মহাবিশ্বের সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই তা ক্রমশ বাড়ছে, চুপসে যাওয়ার কোন ইঙ্গিত এখনো পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ, ইত্যাদির মতো উন্নত মানের দূরবীনের সাহায্যে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের যে তথ্য মিলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, ব্রহ্মাণ্ড ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে এবং আশ্চর্যের বিষয়: এই প্রসারণের বেগ উত্তরোত্তর বাড়ছে। অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র, কৃষ্ণগহ্বর সহ সমস্ত মহাজগতিক বস্তু ক্রমশ বেগ বাড়িয়ে নিজেদের থেকে দূরে আরও দূরে সরে সরে যাচ্ছে। কয়েকশ’ কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রপুঞ্জের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে –ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর্ব থেকে মাঝামাঝি সময়ে এসে এর প্রসার বা ছড়িয়ে পড়ার গতি বেড়েছে। মহাবিশ্বের প্রসারিত হওয়ার এই ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করা হয় নক্ষত্রমন্ডলী থেকে ধেয়ে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে। দেখা যাচ্ছে –নক্ষত্র থেকে আসা আলো লাল তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের দিকে সরে যাচ্ছে, যাকে বলা হয় রেড-শিফ্ট। একটি আলোক বর্ণালী লাল তরঙ্গের দিকে সরে যাওয়া মানে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ছে, ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় ‘ডপলার এফেক্ট’ অনুসারে সে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু সরতে সরতে সে যাচ্ছে কোথায়? নিশ্চয় কোন এক অজানা স্থান-কাল সাদরে আমন্ত্রণ করছে প্রসারমাণ ব্রহ্মাণ্ডকে। তাহলে কি মহাবিশ্বের কোন সীমা পরিসীমা নেই?

সাম্প্রতিক কালের জ্যোতির্বিদদের যুক্তি –সূচনা পর্বে যে পরিমাণ শক্তি মহাকাশে ছড়িয়ে ছিল তা ভরে রূপান্তরিত হয়ে গ্রহ নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়েছিল, ফলে মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ কমেছে। সেদিক থেকে বিচার করলে স্ফীত হওয়ার গতিবেগ কমে আসারই কথা। আর এই যুক্তির উপর ভর করেই ধরে নেওয়া হয়েছিল –স্ফীতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছালে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ফের সংকোচন শুরু হবে এবং ছোট হতে থাকবে ব্রহ্মাণ্ড। বর্তমান পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে –মহাবিশ্বে এমন কিছু আছে, যার ফলে মহাজাগতিক বস্তুদের মধ্যে আকর্ষণের পরিবর্তে বিকর্ষণ বল কাজ করছে, ফলে সে ক্রমশঃ স্ফীত হচ্ছে। কি সেই ‘এমন কিছু’; তা কি রহস্যাবৃত ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি?

ডার্ক ম্যাটারডার্ক এনার্জি এক বিষম বস্তু:

সাম্প্রতিক কালের সমস্ত মহাকাশ গবেষণা লব্ধ পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীদের অনুমান –সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাত্র ৫ শতাংশ বাহ্যিক বস্তু দিয়ে তৈরি, যার আবার একটা ক্ষুদ্রাংশ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিগোচর। বাকি ৯৫ শতাংশই অজানা বস্তু ও শক্তি দিয়ে পরিপূর্ণ, যাকে বলা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। এই অজানা ভর ও শক্তির একটি যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ আছে – ‘তমোপদার্থ’। বিজ্ঞানীরা কিভাবে এই ধারণায় উপনীত হলেন?

মহাকর্ষের প্রভাবে তারাগুলো ছায়াপথের কেন্দ্রের চারদিকে আবর্তন করে চলেছে, যা অনুসরণ করে প্রকৃত ভর নির্ণয় করা হয় এবং গ্যাসপিণ্ডের নিজস্ব ভর যোগ করে সমগ্র ছায়াপথের দৃশ্যমান উজ্জ্বল পদার্থের ভর নির্ণয় করা যায়। এটা করতে গিয়েই বিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়কগাছ। হিসেব বলছে –দৃশ্যমান ভরের চেয়ে প্রকৃত ভর অনেক অনেক বেশি। ১৯৩২-৩৩ সালে দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর গবেষণায় এই ফারাকটি প্রথম সামনে আসে। এরপর তমোপদার্থের উপস্থিতির পক্ষে আরও অনেক ধরনের পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ (মহাকর্ষীয় লেন্সিং, ছায়াপথের ঘূর্ণন বেগ, গ্যাসের তাপমাত্রার বণ্টন, ইত্যাদি) পাওয়া যেতে থাকে। যদিও অজ্ঞাত প্রকৃতির তমোপদার্থ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ শোষন বা নিঃসরণ কোনটাই করে না, এরা এসব তরঙ্গের সাথে কোন ধরনের মিথস্ক্রিয়াই করে না, ফলতঃ দূরবীন দিয়ে সরাসরি দেখার কোন উপায় নেই, পুরোটাই কালো অন্ধকারে ঢাকা।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে: কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ব্রহ্মাণ্ডের একটা বড় অংশ অজানা বস্তু দিয়ে তৈরি। যদিও অন্য একটা অংশের মতে, মহাকর্ষের যে নীতির কারণে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের কথা বলা হচ্ছে, স্বয়ং সেই নীতিকেই বিশেষ ক্ষেত্রে সংশোধন করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। যাই হোক এই অজানা অজ্ঞাত বস্তু ও শক্তির স্বরূপ সন্ধানে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ জারি থাক। এক একটি অজানা তথ্যের সমাধান মানে আরও কোন বৃহৎ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। অথচ আমরা পৃথিবীর ক্ষুদ্র গণ্ডিতে বসে ফসিল ফুয়েল পোড়ানো আর তার হাত ধরে প্রকৃতি পরিবেশের বিনষ্টিকরণ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অজানা শক্তির সাথে বিশ্ব-প্রকৃতির সম্পর্ক কেমন সেই জ্ঞানকে বিস্তারিত ও বিকশিত করাই আজকের কাজ। প্রশ্ন, পরিপ্রশ্ন, উত্তর –এই নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ‘হায়ার সেল্ফ’কে উচ্চতর জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা যত জানবেন, সমস্যাগুলোর যত দ্রুত সমাধান হবে, তত বেশি সে স্বাধীন হবে, নিত্য নতুন বস্তু জগতের বিকাশের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান ভাবনা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এবং খুব সঙ্গত কারণেই ঈশ্বর ভাবনা থেকে বিজ্ঞানের দূরত্ব আরও দ্রুত বেড়ে যাবে।

নলেজ তথা জ্ঞান এক সামাজিক সম্পদ:

নলেজ বা জ্ঞান গড়ে উঠেছে কালের সরণি বেয়ে অসংখ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা– অধ্যাবসায়– আবিষ্কার– অভিজ্ঞতার যোগফল হিসেবে। আর বিশ্বগ্রামে ও অসীম মহাকাশের সুদূর পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এখনও অজানা অপরিচিত রহস্যের সমাধান আন্তর্জাতিক পরিসরেই সম্ভব। অথচ ভারতবর্ষের মতো দেশে বিজ্ঞান-যুক্তি-বোধের চর্চাকে বিশ্ব চরাচরে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে  দেশীয় ঘরানার ক্ষুদ্র খাঁচায় আবদ্ধ করার প্রাগ-ঐতিহাসিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বরং পিছনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে তাকে অন্ধকারের অতল গহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোন্ ভয়ানক কৃষ্ণগহ্বরের গভীর কালো গর্তে সামাজিক জ্ঞান ও সম্পদকে  বন্দী করার মধ্যযুগীয় প্রচেষ্টা চলছে, তা খোদায় মালুম!

আর অন্যদিকে বিশ্বজুড়েই মূলত অর্থ (money) তথা কর্পোরেটের সেবায় নিয়োজিত ও তার দাসত্ব করতে গিয়ে বিজ্ঞান আজ সম্পূর্ণরূপে ফেটিসাইজড (বিমূর্ত কাল্পনিক ঈশ্বর স্বরূপ)। সমাজ-প্রকৃতি-মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ক্ষীণ হতে হতে সরু সুতোর ডগায় ঝুলছে। বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক জ্ঞানকে ব্যাঙ্কিং- পুঁজি ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে ফুলেফেঁপে ওঠা কাল্পনিক পুঁজির (ফিকটিশাস ক্যাপিটাল) আরও আরও বিনিয়োগ ও মুনাফার করাল গ্রাস পুরোপুরি গিলে ফেলেছে।

এখান থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত করতে না পারলে মানুষ প্রকৃতি সমাজ সভ্যতা কারোরই মুক্তি সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি বিজ্ঞানের সব শাখাগুলির যখন ইন্টিগ্রেটেড হওয়া প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানের অজানা অপরিচিত দুরুহ সমস্যার সমাধানে, বিনষ্ট বিপর্যস্ত করে দেওয়া জল-স্থল-অন্তরীক্ষ-সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে সমাজ সভ্যতাকে  এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে, ঠিক তখন বিজ্ঞানকে সামগ্রিকতায় না দেখে বিভিন্ন শাখা প্রশাখার ছোট ছোট খোপে বন্দী করে দেওয়া হয়েছে একক ভাবে। এখানেই অর্থ-পুঁজির ফুলেফেঁপে ওঠা কাল্পনিক জগতের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধ বা দ্বন্দ্ব হাজির হয়েছে। যত বেশি বিভাগ-বিভাজন, তত বেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা। চিকিৎসা শাস্ত্রে তো এটা আজ স্ফটিক স্বচ্ছ সহজ সরল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিঙ্গেল উইন্ডোর পরিবর্তে যত বিভাগ, উপবিভাগে রুগীকে চক্কর কাটানো যায় –তত বেশি ডাক্তার, ওষুধ, মেডিক্যাল ইনভেস্টিগেশন, তত বেশি চিকিৎসার সরঞ্জাম। আর সেই হারেই বেড়ে ওঠে ফার্মা কোম্পানির বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা-বাণিজ্য ও লক্ষ্মী-লাভ। আর শিল্প- সাহিত্যের সাথে তো বিজ্ঞানের এক অসেতুসম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। এবার সেই পানে একটু দৃষ্টি প্রসারিত করা যাক।

বিজ্ঞান থেকে শিল্পকলার বিচ্ছিন্নতা:

শ্রম-উৎপাদন-বিজ্ঞানের জগৎ থেকে সাহিত্য – শিল্পকলাকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা আলাদা খোপে পুরে দেওয়া হয়েছে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারকে আরও প্রসারিত করার স্বার্থেই। শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংগীত-সাহিত্য- শিল্পকলা তার গুণগতমান হারিয়ে আর পাঁচটা পণ্যের মত একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। পুঁজির আধিপত্যের যুগে বিজ্ঞান হয়েছে ‘প্রোডাক্টিভ ফোর্স এবং তা পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিকে বেগবান করার লক্ষ্যেই। ঠিক সেই কারণেই শিল্পকলার সব কটি বিভাগ পরিণত হয়েছে পণ্যে। পুঁজির নিষ্ঠুর অন্ধগতির জন্য ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও বাজারের যে বাস্তব জগৎ, তা বড় বেশি কদাকার-কুৎসিত। আর অন্যদিকে প্রকৃতির সবকিছু সৌন্দর্য: পাহাড়, নদী, সুনীল আকাশ, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা (ডিজায়ার), কল্পনা, শিল্প সাহিত্য আজ অপ্রাকৃতিক (unreal) হয়ে গেছে। অথচ বস্তুগত ভাবে বিজ্ঞানী এবং শিল্পী উভয়ই পৃথিবীকে উন্নত করার লক্ষ্যে নিয়োজিত প্রাণ। নিজের মনন-বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বহির্জগতের দ্বন্দ্বগুলোর সমাধানে কাজ করেন একদল বিজ্ঞানী, গবেষক ও বিজ্ঞান কর্মী। আর একজন শিল্পী-সাহিত্যিক মানুষের অন্তর্জগতের দ্বন্দ্বগুলোকে নিরসন করার চেষ্টা করেন তাঁর শিল্পসত্ত্বা ও মেধাকে ব্যবহার করে। শিল্পকর্ম মানুষের মননে ভাস্বর হয়ে ওঠে। আসলে বিজ্ঞানী ও শিল্পী দুজনেই সমাজ-সভ্যতার প্রগতির লক্ষ্যে সৃজনশীল কাজে যুক্ত। অথচ পুঁজির আধিপত্যের যুগে ফাটল ধরেছে এই মিলনসুত্রেই।

আজকের সময়ের দাবি বিজ্ঞান ও শিল্পকলাকে হাত ধরাধরি করে– প্রকৃতি থেকে মানুষের এবং সমাজ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা (alliniation) কাটাতে একযোগে সমলয়ে সমতালে সমসুরে কাজ করে যেতে হবে। তবেই প্রকৃতির সন্তান মানুষ প্রাকৃতিক হবে, বাঁচবে প্রকৃতি-পরিবেশ, বাঁচবে মানব সভ্যতা।

ভারতে বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ চর্চার ঐতিহ্য:

ভারতবর্ষের মননকে বুঝতে হলে যুক্তিবাদী চর্চা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ভারতের অবদান ও বিকাশকে সামনে আনা খুব জরুরি। আর এই ধারাকে সামনে আনতে হলে সবার আগে যাঁদের কথা স্মরণ করতে হবে তাঁরা হলেন: জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট, পৃথিবীর প্রথম দশজন গনিতবিদদের মধ্যে অন্যতম রামানুজন, সি ভি রামন, চন্দ্রশেখর সুব্রামনিয়াম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, অসীমা চ্যাটার্জি সহ অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং প্রকৃতি প্রেমিক মহাকবি কালিদাস, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বস্তুবাদী চর্চার ধারক বাহকদের। এখানেই লুকিয়ে আছে ভারতের আসল ঐতিহ্য। অথচ আজকে ঐতিহ্যের নাম করে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল আই আই টি এর মতো কিছু উৎকর্ষ কেন্দ্রকে ব্যবহার করে বিজ্ঞান চর্চার নাম করে সমাজকে নিয়ে চলেছে এক অলীক জগতে – রামায়ণ, মহাভারত, পুরান, জ্যোতিষশাস্ত্র সহ আদি শঙ্করাচার্যের মনুবাদী গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির জগতে। ঠিক যেন উলোট পূরণের এক রূপকথার গল্প। উল্টোদিকে হেঁটে পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে রুখতে হলে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সেই বহুল প্রচলিত উক্তিটি ‘ব্যাদে সব আছে’ সামনে আনতে হবে। সাথে সাথে ভারতবর্ষে সত্যি সত্যি যে বস্তুবাদী ধারা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান সহ বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের নানান শাখায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাকেই সামনে তুলে আনতে হবে। নাহলে ঐতিহ্যের নাম করে, বিজ্ঞানের নাম করে গণেশের কাটা মুন্ডু জোড়া করার প্লাস্টিক সার্জারি বা মহাভারতে টেস্ট টিউব বেবি, উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মতো গাঁজাখুরি গল্প, অকথা কুকথা প্রচার করে অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের চাষ করা হবে আর এই বিষবৃক্ষের ফল ছড়িয়ে যাবে সমাজের আনাচে কানাচে। তাই বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশকে যেমন একদিকে অর্থের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে, পাশাপাশি রূপকথার মায়াজাল ভেদ করে বিজ্ঞানকে তার স্বমহিমায় সমাজ বিকাশের স্বার্থে উজ্জ্বল আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে। জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে এই প্রত্যয় প্রতিটি বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান কর্মী, যুক্তিবাদী ও গণতান্ত্রিক মানুষকে ভরসা জোগাক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top