তীব্র তাপ প্রবাহ খরা জলবায়ু পরিবর্তন: কৃষক ও শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্য ও জীবন যাপনের ওপর প্রভাব

সন্তোষ সেন

“ঝাঁ ঝাঁ রোদ আকাশ জুড়ে মাথাটার ঝাঁঝরা ফুঁড়ে

মগজেতে নাচছে ঘুরে রক্তগুলো ঝনর ঝন।”

পুরো দক্ষিণবঙ্গ ও ভারতের এক বড় অংশের মানুষজন আপাতত যেন সেই রোদে রাঙা ইটের পাঁজার উপরই বসে আছে সর্বক্ষণ। সকলের মুখে একটাই আকুতি – “বৃষ্টি নামা, নইলে কিচ্ছু মিলছে না।”

গ্রীষ্মকালে যে গরম পড়বে, তাপমাত্রা বেশি হবে সেই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। গরম ও দাবদাহ মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়াতেই দুশ্চিন্তা, দুর্ভোগ, আশঙ্কার সাথে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা আজ দুয়ারে হাজির। ২০২৩ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি বেড়ে যাওয়ার পর ২০২৪ এর জানুয়ারি মাস ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম। এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই তাপমাত্রার বৃদ্ধি সব রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড তৈরি করছে। সেই রেকর্ড ছাপিয়ে আবার নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলার পারদ ৪০-৪৬ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে  এপ্রিল-মে মাস জুড়ে ৬-৭ টি কালবৈশাখী ঝড় বৃষ্টির প্রাপ্তি ছিল পশ্চিমবঙ্গের, কিন্তু তার দেখা নেই।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে –অত্যন্ত তীব্র পরিমাণে দাবদাহ ও অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে সমুদ্র থেকে স্থলভাগে জলীয় বাষ্প ঢুকছে না। বরং পশ্চিম দিক থেকে যেভাবে গরম হওয়া বায়ুমন্ডলের নিচুস্তরে প্রবেশ করছে, তাতে জলীয় বাষ্পের দফারফা হচ্ছে  দিনের বেলায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য না থাকায় কালবৈশাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আর তীব্র তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ ব্যাপকহারে বনাঞ্চল ধ্বংস ও পুকুর খাল নদীসহ একের পর এক জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ কাজ। সবুজ ঘাস, গাছগাছালির পরিবর্তে শহরের রাস্তাঘাট সব মুড়ে ফেলা হয়েছে কংক্রিটের পুরু আস্তরণে। কংক্রিটের জঙ্গলে শোষিত তাপ মাথা কুটে মরছে। রাতেও সেই তাপ বায়ুমন্ডলে বিকিরিত হয়ে ফিরে যেতে পারছে না। এইসব কারণেই কালবৈশাখী এবারে অধরাই থেকে গেছে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় শীতল পবনের দেখা নেই।

শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে বাতাসে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করায় মে মাসের শুরুতে একখানা কালবৈশাখীর দেখা মিলেছে। অথচ কালবৈশাখী গ্রীষ্মকালের দাবদাহে একটি স্বস্তিদায়ক ঘটনা। কালবৈশাখীর মাঝারি মাপের ঝড়ে টিন, খড়ের চাল উড়ে যাওয়ার সাথে কিছু ঘরবাড়ি ভাঙ্গার মতো দুর্যোগ বয়ে আনলেও তাপমাত্রা কমিয়ে দেয় ৭-৯ ডিগ্রি। এবং মাটিতে জল জমা হয়ে কৃষিশস্য, অন্যান্য ফসল ও কৃষকদের জন্য তা আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে ওঠে। এটা ঠিক যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্ত কারণগুলোকে আরও বিশদে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসতে হবে।

ট্রপিক্যাল ফরেস্ট বা ক্রান্তীয় অরণ্য নির্বিচারে ধ্বংস  হবার ফলে গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে হুহু করে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমানে গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গত করে এবং সারা পৃথিবীর পরিবহণের কারণে যে গ্যাস নির্গত হয় তার সমান হল জঙ্গল নিধনের কারণে বাতাসে মিশে যাওয়া গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ। কেন নির্বিচারে বড় বড় ঘন জঙ্গল ও সবুজ বনানীর হত্যালীলা বিশ্ববাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে?

৯৮টি দেশের বিগত ৩০ বছরে বন ধ্বংসের উপর নিবিড় সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে –২০১৫ থেকে ২০২০: এই সময়কালে ভারতে প্রায় ৭ লক্ষ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। ব্রাজিলের পরে দ্বিতীয় স্থানে ভারত। এর সাথে বিশ্বজুড়েই পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গাড়ি শিল্পকে চাঙ্গা রাখার নানান প্রকল্পও বিশ্ব উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে। এর ফলে শ্রমিক কৃষক সহ খেটে খাওয়া মানুষকে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে।

তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে তাপপ্রবাহে আক্রান্ত শ্রমিক কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মানুষের শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে গেলে গুরুতর অসুস্থতা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। বাস্তবে হচ্ছও তাই। বলাই বাহুল্য, উষ্ণতর দেশগুলিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই শ্রমজীবী মানুষ, নির্মাণ শ্রমিক, খনি শ্রমিক, স্বনিযুক্ত শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শ্রমিক, কৃষিজীবী, ক্ষেতমজুর ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যাও অনেক বেশি। ‘দিন আনি-দিন খাই’ মানুষদের দুবেলা দুমুঠো খাদ্য যোগানের জন্য ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ বা প্রায় ৩৮ কোটি মানুষকে প্রবল গরম উপেক্ষা করেই এই মুহূর্তে বাইরে বেরোতে হচ্ছে কাজের তাগিদে। কর্মরত অবস্থায় কোথায় কতজন শ্রমিক চরম তাপপ্রবাহ বা তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বা মারা যাচ্ছেন, তার কোন হিসেব সরকারের কাছে নেই। ফলে ক্ষতিপূরণেরও কোন বালাই নেই। অস্থায়ী শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক কর্মী, গিগ  ওয়াকার্সদের অসুস্থতাজনিত কোন সবেতন ছুটি বা চরম আবহাওয়ায় কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুতে বিমার ব্যবস্থা গল্পকথার মতই বাস্তব সত্য।

আইএলও-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে – ভারত, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় শ্রমিক ও কৃষিজীবীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কিডনির অসুখ দ্রুত বেড়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী কর্মস্থলে অতিরিক্ত গরমের জন্য কিডনি-জনিত অসুখে আক্রান্ত ২.৫ কোটিরও বেশি মানুষ। তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশি। ভোরে ও সন্ধ্যায় ঘরের কাজের পাশাপাশি দিনের বেলায় তীব্র গরমে বাইরে কাজ করতে হয় তাঁদের। কর্মক্ষেত্রে যথাযথ শৌচালয় না থাকায় জল কম খেতে অভ্যস্ত মহিলারা। ২০২২ সালে এক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে –জল কম খাওয়ায় এবং তীব্র গরম ও তাপপ্রবাহে বাইরে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় তামিলনাড়ুর গর্ভবতী মেয়েদের পেটের ভ্রুন/ সন্তান নষ্ট হওয়া এবং প্রসব হলেও কম ওজনের সন্তান জন্মের ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

man harvesting plants
Photo by Asad Photo Maldives on Pexels.com

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন –মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি আমাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দীর্ঘ সময় ধরে রোদে বা তীব্র গরমে বাইরে কাজ করতে বাধ্য হওয়া মানুষজনের হাইপোথ্যালামাস অংশটি তার কাজ বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীরে ঘাম হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনই বাড়ে সানস্ট্রোকের ঝুঁকি, যা মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। এর সাথে যুক্ত হয় মাথা ঝিমঝিম করা, বমি ভাব, অত্যধিক ক্লান্তি, হাতে পায়ে টান, পেটের ব্যারাম এবং ভাইরাল ফিভারের বাড়বাড়ন্ত। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো ক্ষতিকারক অণুজীবের সংক্রমণও বেড়ে গেছে বহুল পরিমাণে। অন্যদিকে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের কারণে দিনের বেলার শোষিত তাপ বিকিরিত হতে না পারায় রাতের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের অনেক উপরে থাকছে। ফলে রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ার কারণে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমছে, বাড়ছে রোগ অসুখ।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং-অতিরিক্ত গরম-তাপপ্রবাহ-খরার কারণে প্রান্তিক মানুষদের কাজের সময় ও সুযোগ কমায় তাঁদের রোজগার কমছে, বাড়ছে স্বাস্থ্য সমস্যা। দৈনন্দিনের সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মানুষ স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বা ঘটিবাটি বিক্রি করে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য কাজের পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মনোযোগ দেওয়ার দরকার ছিল অনেক বেশি করে। দুর্ভাগ্য ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত চারটি নয়া শ্রমকোড শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিকে আগের তুলনায় অনেক শিথিল করেছে। বেড়েছে শ্রমিকদের সংকট। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কাজের যথাযথ পরিবেশ, কর্মক্ষমতা ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, চাকরি ও কাজের সুযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলোতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার দরকার ছিল সরকারের। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে ঠিক উল্টোটাই। কৃষক, শ্রমিক ও কর্মীদের তীব্র রোদে বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে শরীর সুস্থ রাখার জন্য। এর পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকলেও ভারতের মতো দেশে খাদ্য বস্ত্র চিকিৎসা ও শিক্ষাখাতের দৈনন্দিন খরচ যোগাতে শ্রমিকদের কর্মস্থলে না গিয়ে উপায় নেই। তাই সুপরামর্শের বিধি কাগজে কলমেই থেকে যাচ্ছে। পরিবেশ জনিত কারণে কৃষকরা দ্বিবিধ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। সেই দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।

এমনিতেই কর্পোরেটের চাহিদা মতো ও বাজার নিয়ন্ত্রিত হাইব্রিড চাষে খরচ বেড়েছে বহুগুণ। এই চাষে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও জলের প্রয়োজন হয়। একদিকে সার ও কীটনাশকের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির জন্য চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং অন্যদিকে তীব্র গরম-দাবদাহ-খরা এবং কখনও বা অতিবৃষ্টি-বন্যা-প্লাবনে বারবার করে মাঠের শস্য মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। কৃষকরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।

উদাহরণ স্বরূপ পাট চাষের সংকটকে সামনে আনা যাক। কৃষি দপ্তরের তথ্য –গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্রমশ কমে গিয়েছে পাট চাষ। কৃষকদের কাছে পাট এক অর্থকরী ফসল হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত কয়েক বছরে পাটের উৎপাদন কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের নীতিতে পাটজাত বস্তা, ব্যাগের ব্যবহার কমিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়িয়েছে বহুগুণ। বন্ধ হয়ে গেছে বহু পাটকল। এক্সট্রিম আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এই সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে। কৃষকরা পাট চাষে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও কখনো শিলাবৃষ্টি, কখনো বা খরা কৃষকদের বড় ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই মরশুমের শুরু থেকেই তীব্র দাবদাহ ও বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পাট চাষ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। চাষের জমি শুকিয়ে ফুটিফাটা। অনেক জায়গাতেই নেতিয়ে পড়েছে গাছ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পাট সহ সমস্ত কৃষিশস্যের ফলন অস্বাভাবিক রকমের কম হবে বলেই কৃষি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন। সমগ্র রাজ্যেই পাট চাষের অবস্থা ভয়াবহ। কৃষকরা জানাচ্ছেন –“এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই খরচ অনেক বেড়ে গেছে। পাট চাষ ভালো হলে খুব বেশি হলে ৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। কিন্তু এই আবহাওয়ায় চাষের খরচটুকুও উঠবে না।”

প্রতিদিন জলসেচ করেও গাছকে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বাড়তি খরচ করে বেশি সেচ দিয়ে গাছ কোনরকমে বাঁচালেও বৃষ্টির জলের অভাবে শাকসব্জি, ফল সহ সমস্ত কৃষিশস্যের ফলন কমে যাচ্ছে বহুল পরিমাণে। গ্রীষ্মকালীন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও ভয়াবহ। এই  চাষে জল এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অত্যন্ত রকমের বেশি লাগে বলে বিদ্যুৎ বিল সহ চাষের মোট ইনপুট খরচ অনেক বেশি। শাকসবজি সহ ফসলের উৎপাদন অত্যন্ত কম হওয়ার কারণে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম প্রচুর বেড়ে গেলেও সেই পয়সা যাচ্ছেনা চাষীদের কাছে। চাষের খরচ বৃদ্ধি আর অন্যদিকে বাড়তি পয়সা ফড়ে মজুতদারের পকেটে চলে যাওয়ায় চাষী ও উপভোক্তাদের সংকট বাড়ছে ক্রমাগত।

চাষের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়া ও উৎপাদিত ফসলের নায্য দাম না পাওয়ার দ্বিবিধ সংকট থেকে আপাত পরিত্রাণ পেতে ব্যাংক-লোন ও মহাজনি লোনের চক্করে মাথা কুটে মরছেন বড় অংশের কৃষক সম্প্রদায়। কৃষি-লোন শোধ করতে না পারায় কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিল লম্বা হচ্ছে সারা দেশ জুড়েই। প্রধানমন্ত্রী ঋণখেলাপি ধনকুবেরদের লক্ষ কোটি টাকা মুকুব করে দিলেও চাষীদের ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যদিকে চরম তাপপ্রবাহের কারণে ২০১৩-২২ এই সময় পর্বে বিশ্বের ৪৭% কৃষিজমি খরা-কবলিত হয়ে পড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষকদের সংকট গভীর হওয়ার সাথে সাথে খাদ্যসংকটের সম্ভাবনাও বেড়ে গেছে বহুগুণ। বিশ্বজুড়েই খাদ্য নিরাপত্তা এই মুহূর্তে এক বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ৭৯টি দেশের প্রায় ৩৪ কোটি মানুষ বর্তমানে গভীর খাদ্য সংকটের কবলে। মালি, সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদানের কম করে দেড় লক্ষ মানুষ এই মুহূর্তে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। সকলেই জানেন ও মানেন যে, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (২০২৩)-র তালিকায় ১২৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ তম। অর্থাৎ শেষের দিক থেকে প্রথম হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে চলেছে ভারত। খাদ্য সংকটের পিছনে তীব্র আর্থিক বৈষম্য অন্যতম কারণ। আমার দেশে ধান, গম, আখ, পাট, দুধ উৎপাদন বিশ্বে প্রথম দিকে। অথচ এই দেশের শিশু মহিলা সহ সমাজের প্রান্তিক বর্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অপুষ্টির শিকার। দেশের ৭৪% মানুষ পুষ্টিকর খাবার পান না। একেই বলে ভাগ্যের (নাকি পরিস্থিতির) নির্মম পরিহাস। খাদ্য সংকটের চিত্রটা কেমন?

রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ্যান –সারা বিশ্বে প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য গুলির উৎপাদন বৃদ্ধির হার সময়ের সঙ্গে নিন্মগামী। এর সাথে রয়েছে প্রবল আর্থিক বৈষম্য ও খাদ্যপণ্য বিলি বন্টনের গভীর সমস্যা। গ্লোবাল ফুড পলিসি রিপোর্ট (২০২২) – বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে কৃষিতে সংকট ক্রমবর্ধমান। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন সমস্ত ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বহুল পরিমাণে। গবেষণালব্ধ তথ্য –ধরণীর গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ধান গম ভুট্টা পাট সয়াবিন ও টম্যাটোর মতো ফসলের ফলন পাঁচ থেকে আট শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এক্সট্রিম আবহাওয়া যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে খাদ্যের উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এর ফলে বিশ্বের আরও সাড়ে ছয় কোটি মানুষ খিদে নিয়ে রাতে ঘুমোতে যেতে বাধ্য হবেন। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট হল জলবায়ুর পরিবর্তন ও খাদ্যসংকট সহ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আজ মানবসভ্যতা।

ব্যাঙ্ক-ঋণ (এমনকি লুট) ও সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থপুঁজির নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য পাহাড় জঙ্গল জল নদী গ্রাস করার সাথে সাথে কৃষিজমি ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থাটাকেও গিলে খেতে চায় দেশী বিদেশী বহুজাতিক হাঙ্গর কোম্পানিগুলো। কর্পোরেটের স্বার্থে পরিচালিত হাইব্রিড চাষে একদিকে যেমন চাষের খরচ বেড়েছে, পাশাপাশি অপরিমিত জলের ব্যবহারের ফলে জলের সংকট ও দূষণ বেড়েছে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বিষ পুকুর নদী নালাকে বিষাক্ত করার সাথে সাথে বাতাসকেও দূষিত করছে। অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমার পাশাপাশি ঝাঁকে ঝাঁকে ভ্রমর মৌমাছি প্রজাপতির মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। মাটির উপকারী লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়া চিরকালের মতো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেঁকো বিষ জল মাটি বিষাক্ত করার সাথে সাথে খাদ্যপণ্যের সঙ্গে খাদ্য শৃঙ্খলেও প্রবেশ করছে। বহুবিধ বিষ পান করে মানুষ আজ নীলকন্ঠ। কৃষক ও উপভোক্তাদের শরীরে নিত্যনতুন রোগঅসুখ হানা দিচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিকের সামান্য অংশই মাটি ও গাছ শুষে নিতে পারে। বেশিরভাগটাই খাল বিল নদী নালা বেয়ে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের জলের সাথে মিশে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকেও ভয়ঙ্কর বিপন্নতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

এই প্রসঙ্গে অতি সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি রিপোর্টকে সামনে আনা যাক।

ভারতের ৫২৭ রকম খাবার এবং খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে, তা থেকে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ থাবা বসাতে পারে শরীরে। সাথে কিডনি এবং লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। সিঙ্গাপুরের খাদ্য সুরক্ষা দপ্তর ও হংকং প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, ভারত থেকে যেসব মশলা ঐসব দেশে পৌঁছায় সেইসব মশলাতে মারাত্মক কীটনাশকের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা মানব শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। সিঙ্গাপুর প্রশাসন ভারতের কিছু নামী মশলা কোম্পানির প্রোডাক্টকে তাদের দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য সুরক্ষা বিভাগ খাদ্যের গুনগত মান পরীক্ষা করে রিপোর্ট পেশ করে। আমরা জানি ইথিলিন অক্সাইড খুব উচ্চ মার্গের একটি কীটনাশক, যা কৃষিতে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে এমনিতেই কৃষিতে বহু বিষাক্ত কীটনাশক এবং সার ব্যবহার করা হয় অল্প সময়ে অধিক ফলনের জন্য।

১৯৯১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইথিলিন অক্সাইডকে জেনোটক্সিক কার্সিনোজেন বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ইথিলিন অক্সাইডই ধরা পড়েছে ৫২৭ রকম ভারতীয় খাবারে। মূলতঃ প্যাকেট-জাত বাদাম, তিল, অশ্বগন্ধার মতো ভেষজ পদার্থ, মশলা, ৪৮ রকমের ডায়েটিক ফুড ছাড়াও আরও ৩৪ রকমের খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মিলেছে এই ইথিলিন। এভারেস্ট এবং MDH-র মতো নামিদামী মশলা কোম্পানির মশলাতেও মিলেছে ইথিলিন অক্সাইড। আমাদের দেশে খাবার সংরক্ষণের জন্য ইথিলিন অক্সাইডকে প্রিজার্ভভেটিভ হিসাবে বহুদিন ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে এর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এন্ড ফুড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এর তথ্য বলছে –বেশিদিন সংরক্ষণের জন্য, পরিমান বাড়ানো এবং বেশি মুনাফার জন্য কোম্পানিগুলো খাদ্যপণ্যে নানা কেমিক্যাল প্রয়োগ করে। শুধুমাত্র মুনাফার স্বার্থে দেশের মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এবং সরকার এব্যাপারে নীরব থেকে এই স্লো-পয়জনিংকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। দেশীয় কৃষি ব্যবস্থা ও বৈচিত্র্যময় বীজ ভান্ডারকে জাদুঘরে পাঠিয়ে কর্পোরেট চাষ এবং দেশের দশের সমস্ত প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার দখল করে বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পুঁজির জগতের নিজস্ব সংকটের আপত নিরসন হলেও, তা শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষকে এক ভয়ংকর সংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

একদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে হিমালয়ের বরফের চাদর অতি দ্রুত গলে যাচ্ছে। অন্যদিকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে কিছু মানুষের স্বার্থে বয়সে নবীন ও ভঙ্গুর হিমালয়ের নৈসর্গিক প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সহ সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে অপরিকল্পিত অবৈজ্ঞানিক নির্মাণকার্য, হোটেল রেস্তোরা গজিয়ে ওঠা, জলবিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প, ৪-৬ লেনের রাস্তা নির্মাণের মহাযজ্ঞ চলছে মহাসমারোহে। সাথে যুক্ত হয়েছে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির হাতছানি। ফলত লাদাখ-কাশ্মীর হয়ে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের পাহারাদার হিমালয় আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। হিমালয়জাত বড় বড় নদী: গঙ্গা সিন্ধু ব্রহ্মপুত্র অলকানন্দ ধৌলি শুকিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম বাংলার নদনদী, জলাশয়গুলো দূষণ ও নানাবিধ উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ এবং বেআইনি দখলের চাপে জরাজীর্ণ। অথচ নদীমাতৃক সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা আমার দেশের লক্ষ লক্ষ মৎস্যজীবী ও কৃষক সম্প্রদায় ছোটবড় নদী, জলাশয়গুলোর ওপর নির্ভর করে তাঁদের সহজ সরল সাধারণ জীবন যাপন করেন ও কৃষিকার্যে জলসেচের কাজ চালান। আজ এই পথও প্রায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। ফলে মৎস্যজীবী সহ কৃষক ক্ষেতমজুর ভাগচাষীরা ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছেন নতুন করে। বিশ্বজুড়েই বাড়ছে পরিবেশগত উদ্বাস্তু ও দেশান্তরির সংখ্যা।

২০২২-২৩ সালে টানা এক বছর ধরে চলা কৃষকদের মরণপন জেদি ও ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের তেজে ভীত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নয়া তিন কৃষি আইন তুলে নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের একাংশের কয়েক হাজার কৃষক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। তাঁদের দাবি –সকল চাষীর জন্য উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম মূল্যের নিশ্চয়তা (এমএসপি), কৃষিঋণ মুকুব এবং সার এবং বিদ্যুতের অত্যধিক দামে লাগাম টানা। দেশের প্রধানমন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও কৃষকদের ‘মন কি বাত’ শোনার সময় নেই তাঁর। বরং চলমান কৃষক আন্দোলনের উপর সমস্ত নখ দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ প্রশাসন। তাই কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন রাজনৈতিক দলটির নেতা-মন্ত্রীরা হরিয়ানা, পাঞ্জাব ভোট প্রচারে গিয়ে কৃষকদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রচার না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।

বর্তমান ফিন্যান্স পুঁজির যুগে প্রবল বেকারি, তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, কাজের সুযোগ ও সময় কমে যাওয়া, কর্মী সংকোচন, কর্মক্ষেত্রে হাজারো সমস্যা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, গণতন্ত্রের সংকট এবং বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঋতুছন্দ ও জলবায়ু পরিবর্তন: সব মিলেমিশে একাকার, এক বড় মালার নানান গ্রন্থি হয়ে একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। সেই সুতোকে নিয়ন্ত্রণ করছে দেশি বিদেশী কর্পোরেট বাহিনী। তাই পুঁজির সাথে শ্রমের চিরাচরিত দ্বন্দ্বের পাশাপাশি, পুঁজির সাথে প্রকৃতির দ্বন্দ্ব আজ প্রবল আকার ধারণ করেছে। ফিন্যান্স ক্যাপিটাল-র যুগে এই সমস্যাটাই প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে সামনে হাজির হয়ে গেছে বিশ্ব জুড়েই। শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব ও কর্মীরা, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের কর্মীরা, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠকরা এই বাস্তব সমস্যা যত তাড়াতাড়ি আত্মস্থ করে তার সমাধানে এগিয়ে আসবেন, রাষ্ট্রের কাছে সুনির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে  জনগণকে সচেতন করবেন, শ্রমিক কৃষক সহ সকল খেটে খাওয়া মানুষের ততো মঙ্গল।

তথ্যসূত্র:

১। এই সময় পত্রিকা

 ২। দ্যা লেন্সেট কাউন্ট ডাউন অন হেলথ এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট

৩। সরলরেখা: ৮ম বর্ষ;  সংখ্যা ০১৭; 30 April, 2024;  দৈনিক বুলেটিন।

৪। The Hindu newspaper.

লেখক পরিচিতি: বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক এবং প্রাবন্ধিক।

যোগাযোগ: santoshsen66@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top