ছেড়ে আসা শেষ দু’এক দশকের বছরগুলিতে ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নি:সন্দেহে লক্ষ্যণীয়। যদিও একাধিক প্রতিবন্ধকতা ও নানা প্রতিকূলতা রয়েছে ভালোরকম। তাসত্ত্বেও নারী শিক্ষা এগিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে এই প্রভাব অনুভব করছে দেশ। তাই দেশের ভেতরে সমান অধিকারের দাবি আরো বেশী করে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে, এটা খুবই স্পষ্ট যে নারী শিক্ষাকে দ্রুত পুরুষদের শিক্ষার সাথে তুল্যমূল্য হতে হবে এবং উভয়ের মধ্যে সেই বিরাট ব্যবধান অবশ্যই দূর করতে হবে। বিভেদ রয়েছে, বৈষম্যও রয়েছে। সম্পাদকপ্রদত্ত জিজ্ঞাসামালায় তার স্বীকৃতি স্বভাবতই প্রতিফলিত। অভিজ্ঞতার নিরিখে তাকেই যাচাই করতে চাওয়া অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে হয়।
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে প্রায় চারদশক বিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কর্মক্ষেত্র বিদ্যালয়ে বেশীরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ছিল প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এবং আর্থিকভাবে অনগ্রসর পরিবারের। বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যাও কম। তার চেয়ে প্রয়োজনীয় কথা হ’লো আমার এবিষয়ে কোন নিজস্ব তথ্যভান্ডার নেই যা আমি অভিজ্ঞতার নির্যাস হিসাবে জমা করেছি। ফলে স্মৃতির অবশিষ্টাংশ ও সরকারী পরিসংখ্যান আমার পাথেয়। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাগত ও সামাজিক দায়িত্ববোধ আর বিভিন্নভাবে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা। আমার এই অনতিক্রম্য সীমাবদ্ধতা পাঠক নিশ্চয়ই স্মরণে রাখবেন আশা করি।
প্রশ্নগুলো পরপর উত্তর না করে বরং তার দু’-চারটি অংশ নিয়ে বলার কথাগুলো লেখা যাক।
বিদ্যালয়-ছুটের প্রসঙ্গে বলব, ‘মিড ডে মিল’এই ব্যাপারে সমস্যা সমাধানে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। এর আগের পর্বে টিফিনের সময় বাড়ি থেকে আনা দু’-চার আনায় লাঞ্চ সারতো ছাত্র-ছাত্রীরা (আমার বিদ্যালয়ের উচ্চ-মাধ্যমিক বিভাগ কো-এড)। কয়েক মুঠো মুড়ি বা এক-দুটো বাসী রুটি থাকতো তাদের ব্রেক-ফাস্ট। এদের অনেকের অভিভাবকই ভোরের আলো গায়ে মেখে রুজি রোজগারে বেড়িয়ে যেতেন। বিদ্যালয়ে এসে নানাভাবে ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়তো অনেকে। বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি ছিল সাধারণ ঘটনা। ‘মিড ডে মিল’ উত্তর পর্বে এই অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন দেখেছি।
পরবর্তী সময়ে বর্তমান রাজ্য সরকার প্রদত্ত ‘কন্যাশ্রী’ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প বিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। শিক্ষার সুযোগ সাধারণভাবে অনেকটা বেড়ে যায় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে, যাকে সর্বশিক্ষা বলা হয় (RTE 2009), তা সংবিধানে ‘ফান্ডামেন্টাল রাইটস’ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ায়। মেয়েদের বিদ্যালয়ে আসার দাবীটা পরিবারে, বিশেষত গরীব ও নিরক্ষর পরিবারগুলোতে, বিলাসিতা বিবেচিত হতো। রাজনৈতিক লক্ষ্য এখানে আলোচ্য না করেও বলা যায় সব মিলিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষার একটা আনুভূমিক বিস্তার এর ফলে ঘটে সারা দেশে। বাম সরকারের আমলে এরাজ্যে আংশিক ভূমি সংস্কার, বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা ও বেতন বৃদ্ধিরও এই বিস্তারে রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। এবার একটু ছন্দপতন দেখা যাক।
২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১০,৯৮,৭৭৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল, যেখানে ২০২৩ সালে ৬,৯৮,০২৮ জন শিক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (WBBSE) এর তথ্য অনুসারে। অর্থাৎ এক বছরে ৪,০০,০০০ এর বেশি শিক্ষার্থী হ্রাস। এবার পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলের সংখ্যা অনেকটাই কম। ছেলেদের সংখ্যা ২,৯০,১৭২ এবং মেয়েদের সংখ্যা ৩,৫৮,০০০। একটা বড়ো কারণ যে কোভিড তাতে সন্দেহ নেই। WBBSE সভাপতি বলেছেন: “এটি মহামারীর কারণে ঘটেছে। অনেকেই প্রস্তুত না হওয়ার কারণে স্বেচ্ছায় পরীক্ষা দেন না। অনেকেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। কোভিডের কারণে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। তাই প্রার্থীর সংখ্যা কম।” অন্য কারণও আছে। অনেক শিক্ষার্থী, প্রধানত ছাত্ররা আর্থিক কারণে স্কুল ছেড়ে কোভিডের সময় বা তার পরেপরেই খুব কম বেতনের অস্থায়ী ও পরিশ্রমসাধ্য কাজে (ডেলিভারী বয়, শপিং মলের বিক্রেতা, সিকিউরিটি বা সাফসুরতের কাজ যার মধ্যে আবার তুলনায় কুলীন) জুড়ে গিয়ে স্কুল-ছুট হয়েছে।
এছাড়াও সরকারি স্কুলে পরিকাঠামোর অভাব। ফলে সাধারণ মানুষ সাধ্যকে অতিক্রম করেও বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। রাজ্যে প্রায় দুই লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য থাকলেও সেগুলি পূরণ করা হচ্ছে না।পাবলিক স্কুলে রয়েছে খারাপ পরিকাঠামো, খারাপ শ্রেণীকক্ষ, সুযোগ-সুবিধার নানা অভাব। কিন্তু একই সঙ্গে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর জন্য তা বেসরকারী ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী এটা স্পষ্ট। এটাও আশ্চর্যের কিছু নয় যে, আজও ভারতীয় সমাজ পুরুষ শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। বাবা-মায়েরা ছেলেদের জন্য আরও ভাল শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরিবারগুলি তাদের ছেলে সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছে যাতে তারা আরও ভাল সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। তুলনায় তাদের মেয়ে সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠান তারা। ছাত্র ও ছাত্রী শিক্ষার্থীর সংখ্যাগত পার্থক্যের আলোচনায় এই বিষয়টা তুলনায় কম আলোচিত।
সরকারী বিদ্যালয়ভিত্তিক পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে এদেশে অধিকাংশই বিনামূল্যে পাবলিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। ভারত সরকার অনেক দেরীতে দায়িত্ব নিয়েছে এবং ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনও (RTE) লাগু করেছে, যা ১৪ বছর বয়স (অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত সমস্ত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু, অষ্টম মানের (উচ্চ প্রাথমিক স্তর) পরে কী হবে? যা ঘটার তাই ঘটছে। নবম-দশম স্তরে পৌঁছানোর আগেই স্কুল-ছুট সর্বাধিক অষ্টম শ্রেণিতে। একটু অন্যান্য শ্রেণীর পরিসংখ্যানে তাকানো যাক। উচ্চ প্রাথমিকে অর্থাৎ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ১০০ জন ছাত্রীপ্রতি ছাত্রের সংখ্যা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যেখানে ১০৬.৯ আমাদের রাজ্যে তা ১০০.৯। নবম-দশম শ্রেণীতে তা আরো কমে দাঁড়াচ্ছে ৯২.৯। যদিও এক্ষেত্রে ভারতীয় গড় ১০০.৮। অর্থাৎ এরাজ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সংখ্যায় অষ্টম শ্রেণীর পর স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় ছাত্রীদের অধিক সংখ্যক উপস্থিতি এই দুঃখজনক চিত্রেরই প্রতিফলন।
শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের বঞ্চনার অবসান হবার কোন লক্ষণই চোখে পড়ছে না কারণ শিক্ষাশেষে একটি খেয়ে পরে বাঁচার মতো সংস্থান রয়েছে এ ধরনের চাকরি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১০০ জন ছাত্রী পিছু ছাত্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কালিম্পং জেলায় ( ৯৬.০) আবার সবচেয়ে কম উত্তর দিনাজপুর জেলায় (৬০.৫ ), মুর্শিদাবাদের তা ৬১.৪, মালদহে ৭১.৪। এমনকি মাধ্যমিক স্তরেও অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণীতে ১০০ জন ছাত্রী প্রতি ছাত্রের সংখ্যা উত্তর দিনাজপুরে ৭৩.৯, মালদহে ৮৪.৩, মুর্শিদাবাদে ৮৫.১ অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীর পরেই তুলনামূলকভাবে উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহে বেশি সংখ্যায় ছাত্ররা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। খোঁজ করলেই জানা যাবে এই স্কুলছুটের দল অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দিচ্ছে, অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে গত দশ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে যে, ২০১০-২০১১ সালে আমাদের রাজ্যে স্নাতক স্তরে প্রতি ১০০ জন ছাত্রী পিছু ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১৩৩.৭ আর ২০২০-২০২১ সালে তা দাড়িয়েছে ৯২.৯ জন, যেখানে সর্বভারতীয় গড় ১০৫.৩।
রাজ্যে স্ত্রী শিক্ষার আপাত গোলাপ-সদৃশ্য পরিসংখানের আলো-আঁধারীর মধ্যে শিক্ষার প্রতি ছাত্রদের অনাস্থা কাঁটা হিসাবে বেঁধে না কি! হাতে রইল পেন্সিল। কড়-গোনা কয়েকজন ‘ভাগ্যবান’ ছাত্র-ছাত্রীর বাৎসরিক কয়েক লক্ষ টাকার (Lac per anum) আয়ের চিত্র তুলে ধরে বিদ্যালয় ছুট কমানো যায় না, যাবেনা।
NSSO পরিসংখানের আংশিক উল্লেখ প্রশ্নপত্রে রয়েছে। এই সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান (২০১৮) অনুসারে ছাত্রীদের স্কুল ছেড়ে দেবার মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: গার্হস্থ্য কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা (৩০%), শিক্ষায় আগ্রহের অভাব (১৫%), এবং বিবাহ (১৩%)। অন্যদিকে, ছাত্রদের স্কুল ছাড়ার মূল কারণগুলি হল: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়জিত হয়ে যাওয়া (৩৭%), আর্থিক সীমাবদ্ধতা (২৪%), শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাব (১৯%)।
ছাত্রীদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার কারণগুলির মধ্যে একটি কারণ একান্ত তাদের নিজস্ব অর্থাৎ বিবাহজনিত (অপর লিঙ্গের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তুলনায় কম)। আগ্রহের অভাবের শতকরা অংশ থেকে বিবাহজনিত কারণ শতকরা বিচারে পিছিয়ে থাকলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক সমীক্ষায় চিত্রটি করুণতর হবে সন্দেহ নেই। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায় সমান আর্থিক ক্ষমতা সত্বেও গ্রাম ও শহরে এই পার্থক্য যে স্পষ্ট, পৌর অঞ্চলের চেয়ে পঞ্চায়েত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত বন্ধুদের সঙ্গে কর্মজীবনকালে কথা বলে এই সমস্যার গভীরতা আন্দাজ পেয়েছি বারবার। নিজের বিদ্যালয়ে দেখেছি বড়ো ছুটির পর স্কুলে আসার সময় বেশ কয়েকজন ছাত্রীই সদ্য-বিবাহিত। অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন যে সম্প্রতিকালে হয়েছে তা দাবি করা যাবে না।
এই সমস্যার সমাধানে শিক্ষায় ছাত্রী অনুদানের মতো আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থাটি কার্যকরী হলেও সামাজিক ব্যবস্থাটির প্রবল চাপ কাটাতে এখনও তা যথেষ্টই নড়বড়ে। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতস্তরে অভিভাবকদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলে একথাই মনে পোক্ত হয়েছে।
আগ্রহের অভাবে স্কুল-ছুট এই কারণটায় লিঙ্গভেদে পার্থক্য কম (ছাত্র ও ছাত্রী যথাক্রমে শতকরা ১৯ ও ১৫) হলেও শিক্ষার ব্যাপারে পাওয়া এই তথ্য একটা সামাজিক অবস্থারও প্রতিফলক। মোবাইল আসক্তি, কারণে অকারণে ‘ট্রিট’ অর্থাৎ দলবেঁধে হুল্লোড়, তরল ও নানারকম শুকনো নেশা এসব বিধ্বংসী প্রক্রিয়া যতটা ছাত্রমহলে প্রচলিত, ছাত্রীদের অংশগ্রহণ নানা কারণে তুলনায় অনেকটাই কম যা পড়াশুনায় মনযোগ তথা আগ্রহ বাড়াতে সহায়ক। এব্যাপারে ছাত্রীরা তাই কিছুটা এগিয়ে। অনাগ্রহের অন্য একটা কারণ অবশ্যই প্রনিধানযোগ্য। চাকুরি পাওয়ার গভীর অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীদের কাছে পড়াশুনা ক্রমশ: অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। বিদ্যালয়ের পড়াশুনায় মেয়েদের এই লক্ষ্যমুখী প্রস্তুতির চাপ তুলনায় কম। তাই বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে তাদের মনযোগ ও আগ্রহ তুলনায় কিছুটা বেশী। এছাড়া পরিবারে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য কিছু করে দেখানোর জেদী মনোভাবেরও জাতক।
বিজ্ঞান শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় বেশী, পরিসংখ্যান এই কথা না বললেও মোটের উপর সংখ্যা বাড়ছে এসব কারণেও। ছেলেরা কারিগরি বিদ্যায় অংশ নিয়ে পড়াশুনা শেষ করতে চাইছে। লক্ষ্য দ্রুত একটা চাকরির জোগাড়। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে সেই কারণে ছাত্রীসংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। অনেক অসুবিধা রয়েছে। উচ্চশিক্ষা যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য সন্দেহ নেই। দু’স্তরেই প্রাইভেট টিউটর এখন ‘মাস্ট’। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে দূরের শহরে পড়তে যাওয়া এর সবকিছুতেই মেয়েদের সমস্যা অনেক বেশী একজন ছেলের তুলনায়।
বিজ্ঞান শিক্ষার সাধারণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে বিমূর্তকরণের সমস্যা। বিজ্ঞান পাঠে, শিক্ষক জীবনের বৃহত্তর পর্বে দেখেছি পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ -সিদ্ধান্ত এই পদ্ধতিতন্ত্র না মেনে পাঠ্যপুস্তক গুলো লেখা হয়েছে মূলতত্ত্ব-পরীক্ষা-ফলাফলের ধারাবাহিকতায়। হাতে করে পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ মাধ্যমিকস্তরে প্রায় শূণ্য। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার তোতাকাহিনী ছাত্র-ছাত্রী দু’তরফের কাছেই প্রাণহীন ও ভীতিপদ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মেয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বিকল্প (ইউ টিউব ইত্যাদি ভার্চুয়াল ক্লাস ব্যবহারের সুযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থা আয়োজিত কিছু হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার শিবির, প্রকৃতি পাঠের আসর, রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি) ব্যবহারের সুযোগ কম।
গণিতে এই বিমূর্তায়ণজনিত সমস্যটা চুড়ান্তভাবে প্রকট। বিদ্যালয়ে গণিতের পাঠদান যেমন প্রাগৈতিহাসিক (ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অবশ্যই), গণিতের সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকও তথৈবচ। এসবের যোগফলে ভয় স্বত:উৎসারিত। উচ্চ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরে পাঠক্রমের আমূল পরিবর্তন হয়েচে কয়েক দশক হলো। কিন্তু বিদ্যালয়োগুলোর পরিকাঠামো ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ দায়সারাভাবে শেষ করার জন্য পাঠদানে তার কোনই উল্লেখযোগ্য রেখাপাত ঘটেনি বলেই মনে হয়। গণিত-ভীতি দূর করার কিছু উপাদান পাঠ্যপুস্তকে থাকলেও বাস্তব প্রয়োগে তা ঘটেনি। আর এই বাস্তবতায় আজও সমানভাবে লালিত হয় সেই প্রবাদগুলো —বিজ্ঞান পড়া মেয়েদের জন্য নয়, মেয়েরা অঙ্কে সবসময়ই কাঁচা থাকবে। আসলে এই প্রবাদের অন্তর্বস্তুতে রয়েছে সেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তা যা বলতে চায় যে মেয়েরা জন্মগতভাবে বুদ্ধিতে কম, শরীরে কমজোরী, মানসিকভাবে দূর্বল, চিন্তায় পিছিয়ে থাকা।
কয়েকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ অপ-মনস্কতার এই বদ্ধজলায় ঢেউ তুলতে যথেষ্ট নয় একথা সত্যি। তবে দুনিয়ার পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’। লিঙ্গ বিভিন্নতা থাকবে, ভাঙবে লিঙ্গ বৈষম্য। বৈষম্যের নিরসনে ছোট বড়ো সব চেষ্টা, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আগামীতে মিলবে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মহাসাগরে।
(এই নিবন্ধটি বিজ্ঞান দিশারী পত্রিকার ডিসেম্বর, ২০২৩ সংখ্যা থেকে এখানে পুনর্মুদ্রিত করা হল।)